পছন্দ: বইমেলায় সুলেখার স্টলে কালি ও ঝর্না কলম দেখছেন উৎসাহীরা। শুক্রবার, সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
স্কুলশিক্ষকদের তালিমের পাঠ্যক্রমে হাতের লেখা শিক্ষার বিষয়টি রাখা চাই! এমনই আর্জি জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন বিজয়গড় বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক তাপসকুমার দে। ঝর্না কলম কাকে বলে, দেখেইনি ব্যারাকপুরের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া যুবরাজ বিশ্বাস। বইমেলার মাঠে দু’জনের হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। এই ডিজিটাল যুগে হাতের লেখা চর্চায় ফেরার ডাক দিয়ে সল্টলেকের বইমেলার একটি কোণ এ বার সরব। মুছে গিয়েও নতুন করে ফিরে আসা, স্বদেশি যুগের স্মৃতিমাখা সুলেখা কালি এই প্রথম বার বইমেলায় স্টল দিয়েছে।
সুদৃশ্য হাতের লেখা পত্রিকা আর তেমন দেখা যায় না বইমেলায়। ফেসবুকে হাত পাকিয়ে মোবাইলে গল্প, উপন্যাস লিখে ফেলা সাহিত্যিকদেরই ইদানীং পাল্লা ভারী। কিন্তু স্কুলে স্কুলে ঝর্না কলমে হাতের লেখা পোক্ত করার ডাক দিয়ে শখের কলম ক্লাবের কুশীলবেরা বইমেলায় এক অন্য বার্তা দিচ্ছেন। রকমারি কলম সংগ্রাহক তথা ব্লগ লেখক শুভব্রত গঙ্গোপাধ্যায়েরও ধ্যানজ্ঞান কালি, কলমের চর্চায় ফেরা। সুলেখা নতুন করে কালিতে ফিরে তাঁর জীবনেও অক্সিজেন ভরেছে। শুভব্রত, তাপসেরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে ফের ঝর্না কলমে ফেরার কথা বলছেন।
বাড়িতে বড়দেরও স্মার্টফোন, আইপ্যাড নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে ছোটরা। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়ার গবেষণায় প্রকাশ, দশ বছর হাতের লেখার অনুশীলনহীন একটি স্কুলে বাচ্চারা পড়তে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে, নতুন শব্দও তেমন শিখছে না। তাদের স্মৃতিশক্তিও ক্রমশ ভোঁতা হচ্ছে। তাপস বলছিলেন, “অতিমারির স্কুলবিহীন জীবনে গরিব পড়ুয়াদের হাতের লেখা চর্চা ধাক্কা খাওয়ায় সার্বিক শিক্ষাতেও ক্ষতি হয়েছে। ডিজিটাল নির্ভরতা বাড়লেও, ঝর্না কলমে হাতের লেখার তালিম ছাড়া মেধার বিকাশে ফাঁক থাকবে।’’
বেঙ্গালুরুবাসী ম্যানেজমেন্ট ও হস্তাক্ষর চর্চা বিশারদ কেসি জনার্দনও দেশ-বিদেশে হাতের লেখা চর্চার প্রচার করে চলেছেন। তিনি বলছেন, “বয়স্কেরাও হাতে লেখার অভ্যাস ভুলে যাচ্ছেন। টাইপ করে করে হাড়েও রোগ ধরছে। ব্যক্তিগত চর্চার জন্যও হাতের লেখা চর্চা বজায় রাখা ভাল। ছোটদের তো হাতে লিখতেই হবে। কম্পিউটারেও ইদানীং ই-পেনে লেখালেখি বাড়ছে।” তা ছাড়া রয়েছে হ্যাকিং বা তথ্য চুরির ভয়। ইসরো-র মতো সংস্থাও হ্যাকিংয়ের ভয়ে কম্পিউটারের বাইরে প্রিন্ট আউটে সব নথি রাখে। জনার্দনের কথায়, “তথ্য সংরক্ষণ বা বাঁটোয়ারায় কম্পিউটার ভাল। কিন্তু ডিজিটাল ক্রীতদাস হওয়া ক্ষতির। প্রাচীন সাঙ্কেতিক লিপির মতো ইমোজির বহর দেখে মনে হয় আমরা ফের ভাষাহীনতার দিকে হাঁটছি।”
কালির রঙে ইতিহাস, পরিবেশচেতনা উসকে দিচ্ছে সুলেখা। রক্ত-লাল কালিতে একুশে ফেব্রুয়ারি, ঝলসানো রুটির রঙে সুকান্তের কবিতা বা সবুজে পরিবেশবোধের বার্তার প্রচার করছেন কর্ণধার কৌশিক মৈত্র। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত আশির কোঠায় এসে কম্পিউটারে লেখা রপ্ত করেছিলেন। তিনি বলছেন, “স্কুলে কালি-কলমে লেখার বিকল্প নেই। আগামীর লেখকেরা হয়তো কম্পিউটার ও হাতের লেখার মধ্যে ভারসাম্য রাখবেন।”