নিজের বাড়িতে শুভব্রতের বাবা গোপাল মজুমদার। শুক্রবার, বেহালায়। ছবি: শৌভিক দে
জামিনযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল বেহালার বাসিন্দা শুভব্রত মজুমদারের বিরুদ্ধে। আলিপুর আদালতে অতিরিক্ত বিচারবিভাগীয় বিচারক শচীন্দ্রমোহন ভৌমিকের এজলাসে শুক্রবার ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়ে জামিন পান ওই যুবক। তদন্তকারী অফিসারেরা বিচারককে জানান, এসএসকেএমের মনোরোগ চিকিৎসকেরা শুভব্রতকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানোর সুপারিশ করেছেন। সেই মতো বিচারকও তাঁকে কোনও সরকারি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানোর নির্দেশ দেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে শুভব্রতকে বেহালা থানা থেকে প্রথমে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে দেখেন এসএসকেএমের ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি’র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ওঁর সঙ্গে কথা বলার পরে আমার মনে হয়েছে, শুভব্রতের একটা মানসিক ব্যাধি আছে। ওঁর মধ্যে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছে। তাই ওঁকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা দরকার বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’’
এ দিন সকাল থেকে বেহালায় শুভব্রতের বাড়ির সামনে ছিল পুলিশি প্রহরা। দুপুর একটা নাগাদ তিনতলা থেকে একতলায় নেমে আসেন শুভব্রতের বাবা গোপালবাবু। তিনতলা বাড়ির একতলার ঘরে একটি ফ্রিজারে তিন বছর ধরে রাখা ছিল তাঁর স্ত্রীর দেহ! তিনি কি সত্যিই এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না? উত্তরে গোপালবাবু বলেন, ‘‘ছেলে আমাকে নীচের ঘরে যেতে বারবার বারণ করে দিয়েছিল। নীচে নামতে চাইলে ছেলে বকাবকি করত। তাই গত তিন বছরে আমার আর নীচে নামা হয়নি।’’ এ দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ এক আত্মীয়কে নিয়ে গোপালবাবু বেহালা থানায় পৌঁছন। থানার এক আধিকারিক জানান, গোপালবাবুর হাতে স্ত্রীর দেহ তুলে দেওয়া হবে।
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, মায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ কী ভাবে ফ্রিজারে ঢোকানো হবে, সে ব্যাপারে নিখুঁত পরিকল্পনা ছিল শুভব্রতের। ওই যুবক পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁর মায়ের দেহ পিস হেভ্নে প্রায় দু’সপ্তাহ রাখা ছিল। সেই সময়েই এক দিন একটি ফ্রিজার কিনে আনেন তিনি। মায়ের দেহে যাতে কোনও ভাবেই পচন না ধরে, তা নিশ্চিত করতে কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি শুভব্রত। তাই ফ্রিজারটি খারাপ হয়ে গেলে কী করণীয়, তা ভেবে কয়েক দিনের মধ্যেই আর একটি ফ্রিজার কিনে আনেন। যদিও দ্বিতীয়টি কোনও কাজে লাগেনি বলেই তদন্তকারী অফিসারদের জানিয়েছেন তিনি।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, শুভব্রত শুধু ইংরেজিই নয়, রাশিয়ান ভাষাতেও অনর্গল কথা বলতে পারেন। তাঁর বাড়িতে বইয়ের যে ভাণ্ডার আছে, তা দেখার মতো। অ্যানাটমি সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের বই থেকে শুরু করে সাহিত্য বা ধর্মগ্রন্থ— রয়েছে সবই। ইদানীং ইন্টারনেট থেকেও নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে নিজের নোটবইয়ে লিখে রাখতেন শুভব্রত। ওই বাড়ির এক প্রতিবেশী জানান, শুভব্রত তাঁদের সঙ্গে যেটুকু কথা বলতেন, তার বেশির ভাগটাই ইংরেজিতে। ওই পাড়ার আর এক বাসিন্দা অমরকান্তি গুহ বলেন, ‘‘শুভব্রত প্রতিবেশীদের সঙ্গে এতটাই কম কথা বলতেন যে, ওঁর মায়ের সৎকার করার পরে কেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হল না, সেই প্রশ্নটাও আমরা আর করিনি।’’ অমরবাবু জানান, তাঁরা ভেবেছিলেন, শুভব্রতেরা হয়তো ওই সব ধর্মীয় রীতিতে বিশ্বাস করেন না। তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়নি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে পুলিশি জেরার মুখে পুরোটাই ইংরেজিতে জবাব দিয়েছেন শুভব্রত। সন্ধ্যায় খেয়েছেন এক কাপ চা ও দুটো বিস্কুট। রাতে থানায় যা খাবার দেওয়া হয়, তা-ই খেয়েছেন। সকালে উঠে এক কাপ চা ও জলখাবার খেয়ে পুলিশের সঙ্গে আদালতের উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি বলে যান, ঠিকমতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে দেহ সংরক্ষণ করতে পারলে তাঁর এখনও দৃঢ় বিশ্বাস, মা আবার এক দিন বেঁচে উঠবেন।