আর জি কর হাসপাতালের ছাত্রী মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন। —ফাইল চিত্র।
রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আন্দোলন। আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন নিয়ে বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু তাতে একটি বারের জন্য রাজনীতি ঢুকতে দিতে রাজি নন পড়ুয়া আন্দোলনকারীরা। কোনও রাজনৈতিক দলকেই স্বাগত জানানো হয়নি। তাদের সমর্থন জানানো সত্ত্বেও পড়ুয়াদের পক্ষে শাসক ও বিরোধী দলের নেতাদের শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমরা কোনও রাজনৈতিক দলকেই বিক্ষোভে শামিল হতে দেব না। আসতে হলে দলীয় ঝান্ডা রেখে আসুন। ফলে রবাহুতের মতোই থাকতে হয়েছে ডান, বাম সব রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই। যদিও হাল না-ছেড়ে রাজ্যপাল থেকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠিচাপাটি চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সেই সঙ্গে এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডলে প্রতিবাদ।
তবে কি রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতি সম্পর্কে রাগ তৈরি হচ্ছে? না কি কেউ যাতে রাজনৈতিক সুবিধা না-নিতে পারে তা নিশ্চিত করতেই ‘একলা চলো’ নীতি। এমনকি, অন্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের থেকেও দূরত্ব রচনা করতে চেয়েছেন আরজি করের আন্দোলনকারী পড়ুয়া বা জুনিয়র ডাক্তারেরা। এই ব্যাপারে অবশ্য পরে কিছুটা নমনীয়তা দেখা গিয়েছে। তবে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের অংশ হতে গিয়ে পদে পদে বাধা পেয়েছেন রাজনীতিকরা। এ নিয়ে একই মতামত বিজেপি এবং সিপিএমের। দুই দলেরই বক্তব্য, গোটা আন্দোলনটাই আড়াল থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে শাসক তৃণমূল। সে কারণেই আন্দোলনকে ‘গণআন্দোলন’ হতে দেওয়া হচ্ছে না। অন্য দিকে, এ সব দাবি উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের বক্তব্য, সরকার ও প্রশাসন প্রথম থেকে পদক্ষেপ করাতেই রাজনীতি করার সুবিধা পায়নি বিরোধীরা।
শুক্রবার আরজি করের ঘটনা জানাজানি হতেই সেখানে রাজনীতিকরা পৌঁছে যান। বিজেপি নেতা সজল ঘোষ, বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল আন্দোলনে যোগ দিতে যান। সে দিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহ নিয়ে শেষ যাত্রা ছিল। তা শেষ হতে না হতেই পৌঁছে যান সিপিএমের যুবনেত্রী মীনাক্ষি ভট্টাচার্যেরা। এর পরে শনিবারও দিনভর রাজনীতিকরা ওই আন্দোলনের অঙ্গ হতে চেয়েছেন। মৃত তরুণী চিকিৎসকের বাড়িতে যান শাসকদলের দুই প্রবীণ নেতা মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও সাংসদ সৌগত রায়। এর পরেই যান সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। সঙ্গে ছিলেন দীপ্সিতা ধরও। বিকেলে দিল্লি থেকে ফিরেই চলে যান বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। সকলেই বাড়িতে গিয়ে তরুণীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু আন্দোলনের অঙ্গ হতে পারেননি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মিছিল ও সভা করেছেন, কিন্তু মূল আন্দোলনে প্রবেশাধিকার পাননি। অনেকটা দূরে গিয়ে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস এলাকায় মোমবাতি মিছিল করেছেন সুকান্তেরা।
কেন এমন হচ্ছে? রাজনীতিকদের প্রতি এত অনীহা কেন? সিপিএমের পক্ষে দীপ্সিতা বলেন, ‘‘কেন চাইছেন না ওঁরাই বলতে পারবেন। তবে এর পিছনে রয়েছে তৃণমূল। ভিডিয়োতে একটি ছেলেকে দেখছি যে, রাজনীতিকদের ঢুকতে দেওয়া হবে না বলছেন, তিনি নিজেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য। আরজি করের প্রিন্সিপালের ঘনিষ্ঠ ওই ছাত্রের বাবা, মা দু’জনেই তৃণমূলের নেতা।’’ একই সঙ্গে দীপ্সিতার প্রশ্ন, ‘‘আদৌ এই আন্দোলন কি রাজনীতি নিরপেক্ষ? আমরা তো কোনও রাজনৈতিক দাবি তুলছি না, কোনও দলকে নয়, সরকারকে প্রশ্ন করছি। তৃণমূলনেত্রী নন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রীকে প্রশ্ন করছি।’’ দীপ্সিতার কথায়, আরজি করের আন্দোলনকে গণআন্দোলন হতে দিতে চায় না তৃণমূল। তাই এত বাধা। তিনি বলেন, ‘‘গণআন্দোলনে সব দলই রাজনৈতিক ঝান্ডা নিয়ে যেতে পারে। যাঁদের ঝান্ডা নেই তাঁরাও যেতে পারেন। কিন্তু গণআন্দোলন করতে দিতেই চাইছে না। আসলে আন্দোলনের নামে অনেককে বাঁচাতে চাইছেন।’’
দীপ্সিতার সুর বিজেপির সজলের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁরা সকলেই তৃণমূল। লক্ষ্য ভাল হলে কেন রাজনীতিকদের পাশে চাইবেন না?’’ একই সঙ্গে সজলের দাবি, গতকাল আন্দোলনকারীদের বৈঠকে যে গোলমাল হয়েছে তার পিছনেও রয়েছে তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। উত্তরবঙ্গ বনাম দক্ষিণবঙ্গের নেতাদের লড়াই। তবে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতেই রাজি নন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘আমি এ নিয়ে কিছুই বলব না। যা বলার দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন।’’
চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে শনিবার মমতা বলেন, ‘‘এই ঘটনাকে কখনওই সমর্থন করা যায় না। জুনিয়র চিকিৎসকেরা যে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তা সঙ্গত বলেই আমি মনে করি। আমি ওদের দাবির সঙ্গে একমত।’’ মুখ্যমন্ত্রী এমনটাও বলেন যে, ‘‘আমি আমার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি, দোষীদের চিহ্নিত করে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ফাস্টট্র্যাক আদালতে এই মামলা তুলতে এবং প্রয়োজনে ফাঁসির আবেদন জানাতে। কিন্তু, এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই।’’ রাজ্যের পুলিশের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় এজেন্সি তদন্ত করলেও তাঁর আপত্তি নেই বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। আবার শনিবার বিকেলে অভিষেক কড়া বার্তা দিয়ে বলেন, ‘‘এই ধরনের অপরাধ করলে, অপরাধীকে সাত দিনের মধ্যে বিচার শেষ করে হয় এনকাউন্টার করা উচিত, না হয় ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত।’’
সরকারের প্রধান এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এমন বার্তা দিয়ে দেওয়ায় এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপে তৎপরতার জন্যই বিরোধীরা হালে পানি পাচ্ছে না বলে দাবি তৃণমূল নেতা এবং চিকিৎসক শান্তনু সেনের। তিনি বলেন, ‘‘কোনও শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি থাকা উচিত নয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিন্দা করছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়ার পরে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করাটা ঠিক নয়।’’ বিজেপির পক্ষে ইতিমধ্যেই জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত চেয়েছেন সুকান্ত। আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও তদন্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নড্ডাকে চিঠি কিংবা আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। এ নিয়ে সুকান্ত বলেন, ‘‘আমরা কানাঘুষো যা শুনছি, তাতে এই ঘটনার পিছনে আরজি কর হাসপাতালের কোনও ইন্টার্নেরও নাকি হাত রয়েছে। আর পুলিশের ভূমিকা প্রথম থেকেই সন্দেহজনক। দলের তরফে জনস্বার্থ মামলা করতে চলেছি হাই কোর্টে, যাতে আদালতের মাধ্যমে সিবিআই এই ঘটনায় তদন্ত করতে পারে।’’