ছবি প্রতীকী
বছর সাতাশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক তরুণী গত মে-তে কাজ হারান। স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েটি আত্মহননের চেষ্টা করলেও শেষ মুহূর্তে বাঁচানো যায়।
কিন্তু, ৩৮ বছরের বিজয় চৌধুরী? ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক কাজে সহায়কের প্রশিক্ষণে ছিলেন আদতে বিহারের ওই বাসিন্দা। করোনায় কাজ বন্ধ। বাবুঘাটে খেলনা বেচে দেশে সামান্য টাকা পাঠাতেন। গত বছরের মাঝামাঝি বিজয়ের স্থান হয়েছিল লাশকাটা ঘরে।
নিজের জীবন থামিয়ে দেওয়ার এই ঝোঁক বাড়ছিলই। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র ২০২০ সালের রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-এ সারা দেশে আত্মঘাতী হন প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ। অর্থাৎ, দিনে ৩৮৪ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীতে বছরে গড়ে সাত লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। এর জন্য মানসিক অসুস্থতা ছাড়াও দায়ী আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থান। করোনার প্রভাব এই সঙ্কটকে গভীর করছে। আজ, ১০ সেপ্টেম্বর, ‘ওয়ার্ল্ড সুইসাইড প্রিভেনশন ডে’। এ বারের ভাবনা, ‘ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন’, যা কার্যকর করতে বলছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।
প্রায় একশো বছর আগে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র পরেও আত্মহত্যা বেড়েছিল। অতিমারির পরে এমন প্রবণতা নতুন নয়। প্রতিরোধের রাস্তা খুঁজতে হবে। ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের কথায়, “এটা ভুল যে, আত্মহত্যার কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মুখেই হুমকি দেন। আশপাশে কারও মধ্যে এমন চিন্তার প্রকাশ দেখলেই সজাগ হোন। রসিকতা না করে চেষ্টা করুন সমস্যা বুঝতে। কর্মক্ষেত্রে তাঁকে চেপে দেওয়ার প্রবণতা বিপজ্জনক। তাঁর সমস্যায় পরিজনেরাও গুরুত্ব দিন।” সুজিতবাবু জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার আগে মানুষের আচরণে কিছু বদল আসেই। কেউ হঠাৎ উইল করেন, কেউ প্রিয় জিনিস দান করেন, কেউ চুপ হয়ে যান, কেউ যোগাযোগ কমিয়ে দেন, কেউ বা নেশার মাত্রা বাড়িয়ে দেন। কারও এমন পরিবর্তন দেখলে সতর্ক হতে হবে।
তথ্য বলছে, এ দেশে আত্মহত্যার ৪৫-৫০ শতাংশই আর্থ-সামাজিক কারণে। সংক্রমণের প্রভাবে পুরুষের তুলনায় কাজ হারিয়েছেন ১৫ শতাংশ বেশি মহিলা। মনোরোগ চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “মহিলাদের কর্মহীন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে সমাজে। পরের প্রজন্মে অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম বাড়বে। নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে একশো বছরে যা যা কাটিয়ে এসেছি, সেখানেই ফিরে যাব। আত্মহত্যা বৃদ্ধির আশঙ্কাও থাকবে। এখন বয়স্কদের একাকিত্ব, শারীরিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা বেড়েছে। ফলে আত্মহত্যাও বাড়ছে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের
মধ্যেও বেড়েছে এই ঝোঁক। অতিমারিতে মনোরোগের চিকিৎসা নিয়মিত না হওয়ায় এই প্রবণতা বাড়তে পারে।” তাঁর আশঙ্কা, শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হলে কম
বয়সিদের মৃত্যু-মিছিলও দেখতে হবে। ২০১৭ সালে মানসিক স্বাস্থ্য আইনে আত্মহত্যা ‘অপরাধ’ তকমা থেকে মুক্তি পেয়েছে। ফলে কার্পেটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য। এতে সরকারের নীতি নির্ধারণেও সুবিধা হবে। আবীরবাবুর পরামর্শ, সংবাদমাধ্যমও আত্মহত্যার প্রতিরোধের বিষয়ে গুরুত্ব দিক। এ বিষয়ে সহমত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রশান্ত রায়ও।
কিন্তু এ দেশে নথিভুক্ত প্রায় দশ হাজার মনোরোগ চিকিৎসক এবং প্রায় দেড় হাজার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিয়ে কী ভাবে পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব? বেসরকারি যে সব সংস্থা এ শহরে মনোরোগ চিকিৎসার পরিষেবা দিচ্ছে, তার মধ্যে আছে মুম্বইয়ের একটি সংস্থাও। সব ধরনের মানসিক চিকিৎসা মিলছে সেখানে। কর্ণধার নীরজা বিড়লাও মানছেন, “কোভিডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বেড়েছে আত্মহত্যা। আমরা অনলাইনেও পরিষেবা দিচ্ছি। টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করলেও মিলছে কাউন্সেলিং।”
তবে সমাজের বৃহত্তর মনের কাছে পৌঁছতে দরকার প্রশাসনের সর্বস্তরে উদ্যোগ, মত প্রশান্ত রায়ের। তাঁর পরামর্শ, “পুরসভা বা ব্লক স্তরেই পরিকল্পনা করতে হবে। বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমীক্ষা চালাতে হবে। স্থানীয় স্তরেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সাধারণ চিকিৎসকদেরই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জিএনএম নার্স, আশাকর্মী ও গ্রামের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কাউন্সেলিংয়ের উপযুক্ত করতে হবে। সমস্যা গুরুতর বুঝলে তাঁরা ‘রেফার’ করবেন। আত্মহত্যা রুখতে পড়ুয়াদের নিয়েও হোক মানসিক স্বাস্থ্যের প্রকল্প।’’