কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটের গঙ্গাযাত্রী নিবাসে চলছে প্লাস্টিকের কারখানা। (ইনসেটে) সাদা মার্বেল ফলকে খচিত প্রতিষ্ঠা সাল। নিজস্ব চিত্র
সাদা মার্বেলের ফলকে কালো হরফে লেখাগুলো ঝাপসা। তবে নির্মাণের তারিখটা জ্বলজ্বল করছে, ১৮৮৩ সাল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ‘মরিবান্ড হাউজ’ লেখাটা শুধু বোঝা যাচ্ছে।
ওই বাড়ির একতলায় দু’টি কারখানা— একটি প্লাস্টিকের ও অন্যটি লুডোর বোর্ড-সহ যাবতীয় কাগজের বোর্ড তৈরির। ‘‘প্লাস্টিকের কারখানাটা আমাদের। অন্যটা বাবার বন্ধুর। অনেক দিন ধরেই কারখানাগুলো চলছে,’’ বলছিলেন চন্দন দে। বাড়ির দোতলায় তাঁরা ভাড়াটে হিসেবে আছেন চার দশক। চন্দনবাবু আরও বললেন, ‘‘এক সময়ে তো পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। অনেক আগে যাঁদের কলেরা বা যক্ষ্মা হত, যাঁরা আর বাঁচবেন না, তাঁদের এখানে আনা হত বলে শুনেছি।’’ চন্দনবাবু স্থানীয় ভাবে যেটুকু শুনেছেন, সেটুকুই জানালেন। তবে তাঁর জানা নেই, তিনি যে বাড়িতে থাকেন, সেটি কলকাতা পুরসভার গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ তালিকাভুক্ত!
অবশ্য ক’জনই বা জানেন কাশী মিত্র শ্মশানঘাটের বিপরীতে রেললাইনের ধারে ওই বাড়িটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে অন্তর্জলি যাত্রার ইতিহাস! ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই যাত্রায় মুমূর্ষু ব্যক্তির নাভির নীচের অংশ গঙ্গায় জলে ডুবিয়ে রাখা হত। জীবিত অবস্থায় তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হত।’’ অন্তর্জলি যাত্রাকে প্রথম সাহিত্যের আঙিনায় এনেছিলেন কমলকুমার মজুমদার, নিজের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাসে। তাঁর সেই অনন্যসাধারণ ভাষ্য, ‘অন্তর্জলী উদ্দেশ্যে আনীত সীতারাম চট্টোপাধ্যায় এই অগণিত বহুর মধ্যে— সেই নিঃসঙ্গ একটি। সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন... ক্রমাগতই বাঙ্ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল।’ পরবর্তীকালে এই উপন্যাস ভিত্তি করেই পরিচালক গৌতম ঘোষ জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ তৈরি করেন।
তবে অন্তর্জলি যাত্রা কবে থেকে শুরু, সে সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য নেই। কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক বলেন, ‘‘প্রায় ছ’শো বছর আগে শান্তিপুর নামকরণ প্রসঙ্গে ‘নদীয়া কাহিনী’ থেকে জানা যায়, ‘পূর্বে এই স্থানে হিন্দুরা তাহাদের মৃতকল্প পিতামাতাকে সজ্ঞানে তীরস্থ করিতে লইয়া আসিত।’ তবে তার আগে নিশ্চয়ই এই রীতি ছিল। মরণাপন্ন ব্যক্তির পরিবারের লোকেদের থাকার জন্য জায়গার দরকার হয়ে পড়েছিল। কারণ, মৃত্যু-প্রহর কখন আসবে, কেউই জানতেন না!’’
হরিপদবাবুই জানালেন, ১৮২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাচার দর্পণে লেখা হয়েছিল, ‘এই কলিকাতা নগরে মৃত্যুকালে প্রায় সকলে গঙ্গাতীরে যায় কিন্তু সেখানে গিয়া সুখে থাকিতে পারে না যেহেতু গঙ্গাতীরে অধিক স্থান নাই... অতএব আমাদের পরামর্শ এই যে যদি কোন ভাগ্যবান লোক দয়া প্রকাশপূর্ব্বক গঙ্গাতীরে চল্লিশ কিম্বা পঞ্চাশটা ক্ষুদ্র ২ পাকা কুঠরী প্রস্তুত করিয়া দেন তবে পীড়িত লোকেরা গঙ্গাতীরে গিয়া সুখে থাকিতে পারে।’ গবেষকদের অনুমান, তার পরেই এই তিনটি ‘মরিবান্ড হাউজ’ তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। প্রসঙ্গত, ‘মরিবান্ড’ শব্দের আভিধানিক অর্থ মৃতপ্রায় ব্যক্তি।
কলকাতা পুরসভা জানাচ্ছে, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটের বাড়িটি বাদ দিয়েও স্ট্র্যান্ড রোড ও স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোডের উপরে আরও দু’টি এমন বাড়ি রয়েছে। তবে স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোডে গিরিশচন্দ্র বসুর তৈরি বাড়িটির ঠিকানার উল্লেখ নেই পুরসভার হেরিটেজ তালিকায়।
স্ট্র্যান্ড রোডে রানি রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাসের তৈরি বাড়িটি নিয়ে আবার শুরু হয়েছে বিতর্ক! কিন্তু বর্তমানে বাড়িটি ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। ক্রমশ অপস্রিয়মাণ অন্তর্জলি যাত্রার ইতিহাসের সঙ্গে-সঙ্গেই যেন বাড়িটির পিলার, ছাদের চাঙড় খসে খসে পড়ছে! বাড়িটির বর্তমান মালিক এক বেসরকারি সংস্থার অভিযোগ, ৬৫/২ স্ট্র্যান্ড রোডের বাড়িটি ২০১১ সালের আগে হেরিটেজ তালিকাতেই ছিল না! আচমকাই নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে হেরিটেজ তালিকায় তার উত্থান! ফলে ওই বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরির নকশার প্রস্তাবও আটকে গিয়েছে। যদিও পুরসভা সেই দাবি খারিজ করে জানিয়েছে, শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওই বাড়ি ওতপ্রোত জড়িত। তা ভাঙার প্রশ্ন নেই। এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘অন্তর্জলি যাত্রার সঙ্গে এ বাড়িটি জড়িয়ে আছে। ফলে এর সংস্কার করতেই হবে।’’
কিন্তু সে সংস্কার কী ভাবে হবে, তার রূপরেখা কী, তা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশ নেই। পুরসভা শুধু ওই বেসরকারি সংস্থাকে জানিয়েছে, বাড়িটির কাঠামোগত অবস্থা সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে খড়গপুর আইআইটি-কে দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হবে। পরে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সংস্কারের সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু সেটাও গত নভেম্বরের ঘটনা। তথ্য বলছে, এখনও সে বিষয় একটুও এগোয়নি! শুধু সময় এগিয়েছে নিজস্ব নিয়মে। আর সময়ের সেই নিজস্ব গতিতেই প্রতিদিন একটু একটু করে অন্তর্জলি যাত্রার ইতিহাস-জড়িত বাড়ি ভেঙেচুরে কোথাও মাটিতে মিশে যাচ্ছে, আবার কোথাও সেই ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে লুডো-বোর্ড!