মাসান্তে ৪৬ হাজার টাকা বাঁচাতে গিয়ে ১৫ কোটি টাকা জলে দিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর! তার সঙ্গে চরম হেনস্থা হচ্ছে রোগীদেরও।
রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতালে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যতম ‘শোকেস’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগকে। গত চার বছর সেই বিভাগটিই অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। একাধিক বার স্বাস্থ্য ভবনে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল না হওয়ায় এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য: কয়েক জন শিক্ষক-চিকিৎসক, মাসান্তে তাঁদের লাখ-লাখ টাকা বেতন, সব মিলিয়ে ১৫ কোটি টাকা দামের সরঞ্জাম— সবটাই জলে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, স্থান সঙ্কুলানের টানাটানির মধ্যে রোনাল্ড রস বিল্ডিং-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবনে বড়সড় জায়গাও দখল করে রয়েছে ওই বিভাগ। যার নিট ফল শূন্য। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে চিকিৎসকদের আর্জি, ‘অর্থ এবং মানব সম্পদের এমন অপচয় আর বরদাস্ত করা যাচ্ছে না। এ বার কিছু একটা করুন। তা না হলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারের সদিচ্ছার উপরে ভরসা হারাবেন সাধারণ মানুষ।’
হাসপাতাল সূত্রে খবর, স্রেফ পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গামা ক্যামেরা। পুরু ধুলোর আস্তরণ অন্যান্য সরঞ্জামেও। বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক এবং অন্য কর্মীদেরও কোনও কাজ নেই। প্রতি দিন নাম-কা-ওয়াস্তে হাজিরা দিয়ে, চা খেয়ে, গল্পগুজব করে চলে যেতে বাধ্য হন তাঁরা। কেন এই দুরবস্থা? তার কারণ, যন্ত্র চালানোর জন্য এক জনও টেকনিশিয়ান নেই। ন্যূনতম এক জন টেকনিশিয়ান না থাকলে বিভাগ চালানোর অনুমতি দেয় না ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। বাধ্য হয়েই তাই ঝাঁপ ফেলতে হয়েছে।
কেন টেকনিশিয়ানের ব্যবস্থা করা হল না, নেপথ্যের সেই কাহিনিও চমকে দেওয়ার মতো। সেটা কেমন? হাসপাতাল সূত্রে খবর, এই টেকনিশিয়ানদের চাকরির বাজার যথেষ্ট প্রশস্ত। সরকারি চাকরিতে তাঁদের যা বেতন, তার চেয়ে বেসরকারি কেন্দ্রে তাঁরা অনেকটাই বেশি পান। তাই তাঁদেরও বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজের আগ্রহ বেশি। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে চুক্তির ভিত্তিতে দু’জন টেকনিশিয়ানকে নিয়োগ করা হয়েছিল মাসান্তে ২৩ হাজার টাকা বেতনে। চুক্তি যখন নবীকরণের সময় হয়, তখন ওই টেকনিশিয়ানরা বেতন কিছুটা বাড়াতে বলেছিলেন। কিন্তু শীর্ষ কর্তারা তাতে আগ্রহ তো দেখানইনি, উপরন্তু জানিয়েছিলেন, এর পরে মাসে দশ হাজারের বেশি তাঁরা দেবেন না। ফল যা হওয়ার তা-ই। শূন্য ঘরে যন্ত্র আগলে বসে থাকছেন চিকিৎসকেরা। অনেকেই প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন, ‘‘কাজ ভুলতে বসেছি। অন্য কোথাও পাঠিয়ে এই নিষ্কর্মা জীবন থেকে মুক্তি দিন।’’
হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, ‘‘যেখানে ২৩ হাজারেই কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে সেটা আরও কমিয়ে ১০ হাজার করার প্রস্তাব কী ভাবে এল, তা ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। বিভাগটি চালু থাকলে রোগীরা যে পরিষেবা নিখরচায় পেতেন, সেটাই তাঁরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের সন্দেহ, বাইরের ল্যাবরেটরিগুলির অবস্থা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখার জন্য কোনও দুষ্টচক্র এর পিছনে সক্রিয় নেই তো?’’
স্বাস্থ্য সচিব রাজেন্দ্র শুক্লাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ অন্য স্বাস্থ্যকর্তাদেরও। অথচ, আমজনতার উপর থেকে চিকিৎসার খরচের বোঝা কমাতে সরকারি হাসপাতালে সমস্ত চিকিৎসা পরিষেবা নিখরচায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন তাঁর রাজ্যেই সেরা সরকারি হাসপাতাল হিসেবে চিহ্নিত এসএসকেএমের অসংখ্য রোগী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বহু টাকা গচ্চা দিয়ে বাইরের ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছেন। এটা তাঁর নির্দেশকেই কার্যত অগ্রাহ্য করা নয় কি? জবাব মেলেনি সেই প্রশ্নেরও।
থাইরয়েড ক্যানসার, হাড়ের ক্যানসার, ইস্কিমিক হার্ট, লিভারের কিছু চিকিৎসা, হাড়ের ঘনত্ব মাপা ইত্যাদির জন্য ওই পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়েছিল এসএসকেএমের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে। বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘দূর-দূরান্তের জেলা থেকে, এমনকী অন্য রাজ্য থেকেও রোগীরা এখানে আসতেন পরীক্ষার জন্য। রেডিওআইসোটোপের সাহায্যে হার্ট, ফুসফুস, কিডনি, হাড়, থাইরয়েডের হাজারো সমস্যার চিকিৎসা হয়। আমরা সেগুলিই করতাম। রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দুই-ই করার সুযোগ ছিল।’’
বিভাগের প্রধান চিকিৎসক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিভাগটি যাতে দ্রুত চালু করা যায়, তা নিয়ে আমরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। এখনও কিছুই হয়নি। আধুনিক চিকিৎসা যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ অচল হয়ে পড়ে থাকাটা খুবই দুঃখজনক।’’