প্রতীকী ছবি।
সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বছর কুড়ির তরুণ। দুর্নীতি দূর করার আশা নিয়ে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছিলেন তিনি, শঙ্কর ভট্টাচার্য। এর পরে শুধুই স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের পালা। বিজ্ঞাপন বিভাগের চাকরিতে থিতু হয়েও কিছু করার ইচ্ছে চাগিয়ে তুলত তাঁকে। যা পূরণ হল সুকিয়া স্ট্রিটের রামমোহন লাইব্রেরিতে পৌঁছে। আশির দশকের টালমাটাল পরিস্থিতিতে প্রায় জবরদখল হওয়া পাঠাগারকে টেনে তোলেন তিনি। চুয়াত্তরে পৌঁছেও হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবিটিস তাঁকে জব্দ করেনি। এখনও সরকারের ঘর থেকে পাঠাগারের জন্য টাকা নিয়ে আসার ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকেন। লাইব্রেরিয়ানহীন ওই পাঠাগারে গত সাত বছর ধরে তিনিই কান্ডারি। অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে হলেও প্রতিদিন অক্ষরের খনিতে ধুলো উড়িয়ে রত্ন বাছেন ‘তরুণ’ শঙ্কর। ঝাড়াই-বাছাই করে দুর্মূল্য সংগ্রহ দিয়ে পাঠাগারের তেতলার একটি অংশে রামমোহনের সংগ্রহশালা তৈরি করিয়েছেন। রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, নীল বিদ্রোহ থেকে চারু মজুমদার— কোনও স্মৃতিই ধূসর হয়নি, একদা বন্দিমুক্তি আন্দোলনে জড়িত শঙ্করের।
পিছিয়ে নেই বছর আটষট্টির জয়কৃষ্ণ কয়ালও। পড়াশোনা ও কাজের সূত্রে যুক্ত হয়েছিলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের লোকশিক্ষা পরিষদের সঙ্গে। তারও আগে ১৯৭১ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থানার অন্তর্গত নিজের গ্রাম খেজুরতলায় একটি ক্লাব তৈরি করেন জনাকয়েক তরুণের সঙ্গে। লোকশিক্ষা পরিষদের সামগ্রিক গ্রামীণ উন্নয়ন থেকে পাঠ নিয়ে শুরু করেন ক্লাবের কর্মকাণ্ড। অবসর জীবনে মেতে আছেন সেই সব নিয়েই। অস্টিয়োমায়েলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে গত বছর বাঁ পায়ের হাড়, ফিবুলা বাদ গিয়েছে। কিন্তু বারুইপুরের বাড়ি থেকে এখনও নিয়মিত যাতায়াত করেন তিনি। গ্রামের শিশুদের জন্য চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত একটি স্কুল করেছেন তাঁরা। জয়কৃষ্ণ নিয়মিত ভাবে ওদের পাঠ্যক্রমের পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ করেন। লকডাউনে স্কুল বন্ধ। তাই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পড়ুয়াদের ভাগ করে পড়ানো হয়। এমনকি, ফোনে গ্রুপ তৈরি করেও চলে পড়াশোনা ও পরীক্ষা। সবটাই নিয়ন্ত্রণ করেন জয়কৃষ্ণ। গত মে মাসে কোভিড হওয়ায় শারীরিক কষ্ট আরও বেড়েছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পড়াশোনা আর পরিকল্পনা তাঁর থমকে থাকেনি।
যেমন থমকে থাকেননি চির জীবন প্রবাসে থাকা বাঙালি বাণী বল। জন্ম মুম্বইয়ে। তৎকালীন বম্বের একমাত্র বাংলা স্কুলে পড়াশোনা করা বাণীর জীবন এখন আবর্তিত হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার দু’টি পিছিয়ে থাকা গ্রামকে ঘিরে। ৩০ বছর কানাডায় থেকে ২০০৮ সালে এ শহরে আসেন। কয়েক বছর পরে অ্যালঝাইমার’স-এ আক্রান্ত স্বামীর মৃত্যু হয়। কানাডার মন্দিরে সাতশো লোকের রান্না করে তা টিকিট বিক্রির মাধ্যমে পরিবেশন করেন বাণী। সেই উপার্জিত অর্থ এবং সঞ্চয়ের কিছুটা অংশ মিলিয়ে হাড়োয়ার পিলখানা গ্রামের মেয়েদের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সেখানে প্রতি ঘরে। তাই বিনামূল্যে ফিজ়িয়োথেরাপির ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাসাবাটীতে ন্যূনতম টাকায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছেন। আশি বছর বয়সেও সব দেখাশোনা করেন।
শিক্ষকতা করার ছোটবেলার স্বপ্নকে গত ২৫ বছর ধরে আঁকড়ে রয়েছেন খড়দহ-রহড়ার নিখিলেশ্বর ভট্টাচার্য। ‘জুট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া’র এই কর্মী স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন পিছিয়ে থাকা পরিবারে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে। ’৯৬ সাল থেকেই অন্যদের সঙ্গে স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের অবৈতনিক পাঠদানে সাহায্য করছেন। যারা মেধাবী, অথচ অর্থাভাবে পড়াশোনা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাদের পাশে থাকেন নিখিলেশ্বরেরা। বাংলা, ইংরেজি আর সংস্কৃত পড়ান দলের মধ্যে প্রবীণতম, ৮২ বছরের নিখিলেশ্বর। বাকি বিষয় পড়ান আরও অনেকে। শিক্ষক হওয়ার অধরা স্বপ্নকে এ ভাবেই ছুঁয়ে থাকেন তিনি।
ফোনের ও-প্রান্ত থেকে টুকরো স্মৃতিচারণে ধরা দিলেন চার সমাজ-শিক্ষক। যাঁদের আকুতি একটাই, নিজেদের ভালবাসাকে আঁকড়ে বাকি জীবনটুকু বাঁচা।