কখনও ‘কোন পথে যে চলি!’, কখনও বা ‘সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই...।’’
পুজোর দিনে চেনা শহরে বেরিয়েও আমজনতার অনেকেই ‘ছদ্মবেশী’ ছবির এই গানের কলি গেয়ে উঠতেই পারেন। আর জেলার বাসিন্দা কিংবা প্রবাসী বাঙালি হলে তো কথাই নেই। ‘ওয়ান ওয়ে’, ‘টু ওয়ে’, ‘পার্কিং লট’-এর চক্করে ঘেমেনেয়ে একশা হয়ে ঠাকুর দেখার আশাই ছাড়তে হয়েছে, এমন অভিজ্ঞতা উৎসবের শহরে বিরল নয়।
পুজোর সময়ে যানজট কিংবা শহরের গোলকধাঁধার সমস্যা কাটাতে এ বার নতুন পথ বার করছে কলকাতা পুলিশ। লালবাজারের খবর, কোথায় কোন পুজো হচ্ছে, কোন রাস্তায় কতটা যানজট রয়েছে, কোন রাস্তা খোলা আর কোন রাস্তাই বা বন্ধ— এমন নানা তথ্য দিয়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বা ‘অ্যাপ’ তৈরি হচ্ছে। তা তৈরি করতে গুগ্লের সঙ্গে হাত মেলানোর পরিকল্পনাও নিয়েছেন লালবাজারের শীর্ষকর্তারা।
এক কর্তা বলেন, ‘‘গুগ্ল ম্যাপে পুজোর অবস্থান এবং কলকাতা পুলিশের পুজো গাইডকে মিলিয়ে অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে। আশা করছি, এটা চালু হয়ে গেলে আম-নাগরিকদের সুবিধাই হবে।’’ লালবাজারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গুগ্লের কাছ থেকে কলকাতার মানচিত্র নিতে গেলে কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যপার। সেই বিষয়টি নিয়েও ভাবছেন কর্তারা। ‘‘তবে এক বার এটা নিতে পারলে, প্রতি বছরই সুবিধা হবে,’’ মন্তব্য কলকাতা পুলিশের এক পদস্থকর্তার।
পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, পুজোর সময়ে যানজটের আশঙ্কা থাকেই। বদলে যায় যান চলাচলের রাস্তাও। সব মিলিয়ে দর্শকদের অসুবিধা হয়। এর উপরে গত বছরের ‘বড় পুজোর’ স্মৃতি তো রয়েইছে। সেই সব মাথায় রেখেই এ বার পুজোর সময়ে বিশেষ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছেন লালবাজারের কর্তারা। কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, উৎসব কাপের যে প্রতিযোগিতা হয়, তা নিয়েও এ বার নতুন কিছু নিয়ম চালু করা হচ্ছে।
শুক্রবারই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজকদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার। সেখানে তিনি বলেছেন, এ বছর ষষ্ঠীর দিন বিকেল তিনটের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিচারকদের দর্শন সেরে ফেলতে হবে। তার জন্য যা যা সাহায্য করা সম্ভব, পুলিশ করবে। ষষ্ঠীর দিন বিকেল তিনটের পরে আর কোনও মণ্ডপে প্রতিযোগিতার বিচারকদের যাওয়া চলবে না। এত দিন অবশ্য সপ্তমী পর্যন্ত বিচারের কাজ চলত। এই নতুন নিয়মের সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে পুলিশকর্তাদের একাংশ বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে বোধনের সন্ধ্যা থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড়ের ঢল নামছে। তার মধ্যে প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে সিনেমা, সঙ্গীত জগতের তারকারা ঢুকলে আরও হইচই পড়ে যায়। সেই সঙ্গে তাঁদের গাড়ির কনভয় সামলাতেও বেগ পেতে হয়। সব মিলিয়ে মণ্ডপের ভিতর-বাইরে ভিড় সামাল দিতে নাকাল হন পুলিশ ও পুজো কমিটির কর্তারা। সেই বিপত্তি সামাল দিতেই এই নিয়মের সপক্ষে সওয়াল করেছেন লালবাজারের কর্তারা।
ষষ্ঠীর বিকেলের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিচার শেষ করা নিয়ে অবশ্য পুজো কমিটি এবং প্রতিযোগিতার আয়োজকদের অনেকেই আপত্তি করছেন। তাঁরা বলছেন, থিম পুজোয় আলোকসজ্জাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আঁধার না ঘনালে সেই আলোকসজ্জা ফুটে উঠবে না। ফলে লড়াইয়ের একটা বড় আকর্ষণ কমে যেতে পারে। পুলিশ সূত্রের খবর, বৈঠকে যুগ্ম কমিশনারের (সদর) কাছেও এই বিষয়টি তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ এখনও কোনও শিথিলতা দেখায়নি। তবে লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, সময়সীমা সামান্য বাড়ানো যায় কি না, তা ফের এক বার ভেবে দেখা হতে পারে।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছরের স্মৃতি মাথায় রেখে এ বার দেশপ্রিয় পার্কের দর্শকদের ঢোকা-বেরোনোর রাস্তায় কিছুটা বদল এনেছে। এ বারও সেখানে ‘হাজার হাত, হাজার অসুরের’ থিম নিয়ে জনমানসে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। লালবাজারের একাংশ জানাচ্ছে, ভিড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশপ্রিয় পার্ক, গড়িয়াহাট এলাকার যান চলাচল নিয়েও নতুন ভাবে ভাবনাচিন্তা করছেন পুলিশকর্তারা।
লালবাজারের এক পদস্থ অফিসার বলছেন, পুজোর আগে থেকেই গড়িয়াহাট এলাকায় যানজট বা়ড়তে শুরু করেছে। ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারেরা তা ঠিক মতো সামলাতে পারছেন না। শুক্রবারই ওই এলাকায় টহল দিতে গিয়ে যানজটে আটকে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা। যা নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন তিনি। ফলে পুজোর সময়ে একডালিয়া এভারগ্রিন, হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন, ত্রিধারা সম্মিলনীর মতো নামী পুজোর ভিড় এবং গাড়ি সামাল দিতে ওই এলাকার ট্রাফিক পুলিশের অফিসারেরা আদৌ সফল হবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার দেশপ্রিয় পার্কে একটি বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব ট্রাফিক গার্ডের (গড়িয়াহাট, দেশপ্রিয় পার্ক যার আওতায় পড়ে) অফিসারদের পাশাপাশি ওই এলাকায় এক সময়ে কাজ করা দক্ষ অফিসারদেরও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ‘‘ওই অফিসারেরা এখন গড়িয়াহাট এলাকায় কাজ করেন না ঠিকই। কিন্তু ওঁদের পরামর্শ এখন ওই এলাকায় থাকা অফিসারদের ঠিকমতো কাজ করতে শেখাবে,’’ মন্তব্য ট্রাফিক বিভাগের এক পদস্থ কর্তার।