যাদবপুরকাণ্ডে অভিযুক্ত সৌরভ চৌধুরী। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত সৌরভ চৌধুরীই ‘কিংপিন’। আদালতে মঙ্গলবার দাবি করল পুলিশ। কেন তারা এই দাবি করছে, তার সপক্ষে প্রমাণও জমা দিয়েছে তারা। আদালতে জানিয়েছে, প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার মৃত্যুর পর খেকে সৌরভকে ‘বাঁচানোর জন্য’ নানা রকম চেষ্টা হয়েছিল। এমনকি, হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপও খোলা হয়। সৌরভকে নিয়ে পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলতে হবে, চ্যাটের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল সেই নির্দেশও। আদালতে সরকারি আইনজীবী গোটা ঘটনাটিকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলেও দাবি করেন।
প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রের মৃত্যুর পর প্রথম গ্রেফতার করা হয় সৌরভকে। তদন্তকারীরা প্রথম থেকেই মনে করছিলেন, ৯ অগস্ট রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, সৌরভকে জেরা করলেই মিলবে। সে কারণে সৌরভকে দু’বার জেরা করেছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ওই ছাত্রটি যখন মেন হস্টেলের তিন তলা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড়ের পাশাপাশি চলেছিল ‘জরুরি বৈঠক’। সেই বৈঠকের হোতা ছিলেন নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সৌরভই। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হয়েও কেন সেই রাতে হস্টেলে ছিলেন সৌরভ? এমন প্রশ্ন যে উঠতে পারে, তা বুঝেছিলেন তিনিও। পুলিশ আদালতে জানিয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে জানিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ নিজেই। জানিয়েছিলেন, পুলিশ জিজ্ঞেস করলে যেন বলা হয়, মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য যখন কলকাতায় আসেন, তখন হস্টেলে থাকেন।
সেই রাতে যে র্যাগিং হয়েছিল, আদালতে তা-ও দাবি করেছে পুলিশ। মনোতোষের আইনজীবী দাবি করেছেন, তাঁর মক্কেলও র্যাগিংয়ের শিকার। সে কথা রয়েছে তাঁর ডায়েরিতে। সরকারি আইনজীবী সে সব মানতে চাননি। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, চ্যাট থেকে স্পষ্ট, তাঁদের নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্র কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল! তিনি ছাত্রের মৃত্যুকে ‘খুন’ বলেও দাবি করেছেন। আইনজীবীর দাবি, কী ভাবে র্যাগিং হয়েছে, তার সবিস্তারে আদালতে জমা করা হয়েছে। এমনকি, ধৃতদের কাউন্সেলিং করানোর যে দাবি তাঁদের আইনজীবীরা তুলেছিলেন, তা-ও খারিজ করেছেন সরকারি আইনজীবী। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘ওঁদের আবার কি কাউন্সেলিং? ওঁরাই তো কাউন্সেলিং করত!’’
সৌরভ যদিও মঙ্গলবারও আদালতে প্রবেশের সময় চিৎকার করে দাবি করেছেন, তিনি ‘নিরপরাধ’। তাঁকে ‘অপরাধী’ সাজানো হয়েছে। এই দাবি তাঁর নতুন নয়। এর আগে একাধিক বার এই কথাই বলেছেন। গত রবিবার এ-ও দাবি করেছিলেন, যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে মৃত ছাত্রের র্যাগিং হয়নি। তবে পুলিশ তা মানতে নারাজ।
লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, তদন্তে জানা গিয়েছে, সেই রাতে ‘বিবস্ত্র’ করে ঘোরানো হয়েছিল প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রকে। পুলিশ সূত্রে দাবি, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় র্যাগিংয়ের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের সকলেরই ওই ঘটনায় ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের একাংশের। আর সে কারণেই এ বার যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ‘র্যাগিং ইন এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট, ২০০০’ অর্থাৎ, অ্যান্টি র্যাগিং বা র্যাগিং বিরোধী আইনের ধারাতেও মামলা রুজু করার আবেদন করতে চলেছে পুলিশ বলে খবর।
সৌরভকে বাঁচাতে ‘ছক’
তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, ছাত্রমৃত্যুর পরে থেকেই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত সৌরভকে বাঁচানোর একটি চেষ্টা হয়েছিল হস্টেলের মধ্যে। সে জন্য খোলা হয়েছিল একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ। সেখানেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সৌরভের বিষয়ে পুলিশ প্রশ্ন করলে কী বলতে হবে। প্রাক্তনী হয়েও কেন হস্টেলে থাকতেন সৌরভ, সে প্রশ্নের উত্তরও হোয়াট্সঅ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল হস্টেল আবাসিকদের মোবাইলে, যাতে হঠাৎ প্রশ্নের মুখে পড়লে জবাব দিতে অসুবিধা না হয়। মঙ্গলবার আদালতে এমনটাই জানিয়েছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী। তিনি আরও জানিয়েছেন, পুলিশ সম্প্রতি এক ছাত্রের মোবাইল থেকে সেই তথ্য উদ্ধার করেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, চার জনকে নিয়ে একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। সেই গ্রুপের সদস্য সৌরভও। আদালতে ওই তথ্য জমা দিয়ে সরকারি আইনজীবী জানিয়েছেন, হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কেন সৌরভ প্রাক্তনী হয়েও হস্টেলে থাকেন, সেই প্রশ্নের উত্তর। সৌরভ নিজেই সেখানে লিখেছিলেন, ‘‘আমার মা যখন অসুস্থ থাকেন, তখনই আমি হস্টেলে এসে থাকি।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় বাড়ি সৌরভের। সম্ভবত তাঁর মা কলকাতায় চিকিৎসার জন্য আসেন। সেই সময় তাঁকে হস্টেলে থাকতে হয়। এমনটাই বোঝাতে চাওয়া হয়েছিল ওই মেসেজে। পুলিশ ওই হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের এক সদস্যের ফোন থেকেই এই তথ্য পেয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, হস্টেলে কেন থাকেন সে কথা হঠাৎ হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে এত দিন পরে কেন জানাতে হল সৌরভকে?
‘অপরাধী’ নই
তিনি ‘নিরপরাধ’। আবারও দাবি করেছেন সৌরভ। যাদবপুরকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত। মঙ্গলবার পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাঁকে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। আদালতে ঢোকার সময়েই তিনি ওই মন্তব্য করেন। গ্রেফতারের পর গত ১২ অগস্ট সৌরভকে প্রথম আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। সেই দিন তিনি দাবি করেছিলেন, ‘‘আমি নিরপরাধ।’’ এর পর রবিবারও প্রিজ়ন ভ্যান থেকে একই কথা বলেছিলেন। মঙ্গলবার সৌরভ দাবি করেন, তাঁকে ‘অপরাধী’ সাজানো হয়েছে। আলিপুর আদালতে মঙ্গলবার হাজির করানো হয় যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত সৌরভ, মনোতোষ এবং দীপশেখর দত্তকে। তাঁদের পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আদালতে প্রবেশের সময় সৌরভ বলেন, ‘‘আমি অপরাধী নই। অপরাধী সাজানো হয়েছে আমাকে।’’ এর পরেই আদালতের ভিতরে সৌরভকে নিয়ে যায় পুলিশ। এর আগে রবিবার প্রিজ়ন ভ্যান থেকে সৌরভ দাবি করেছিলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের কোনও ঘটনা ঘটেনি। মৃত ছাত্র নিজেই হস্টেলের বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’
যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত সৌরভই ‘কিংপিন’ (মাথা)। মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে এই দাবি করেছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী। ওই দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে অন্য এক পড়ুয়াকে পাঠানো সৌরভের হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাটেরও উল্লেখও করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, প্রথম বর্ষের মৃত পড়ুয়াকে আসলে ‘খুন’ করা হয়েছে। ঘটনাটিকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ধৃতদের মুখোমুখি বসিয়ে আরও জেরার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে তাঁদের পুলিশি হেফাজতের মেয়াদবৃদ্ধির আবেদন জানানো হয়। সেই মতো সৌরভকে ২৫ অগস্ট এবং মনোতোষ, দীপশেখরকে আগামী ২৬ অগস্ট পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। তদন্তকারীদের একাংশ মনে করছিলেন, অভিযুক্ত সৌরভকে জেরা করে যাদবপুরকাণ্ডে প্রয়োজনীয় ‘তথ্য’ মিলতে পারে। সেই কারণে গ্রেফতারের আগে এবং পরে, সৌরভকে দু’বার জেরা করেছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। এ বার আদালতেও পুলিশ দাবি করল, সৌরভই আসলে ‘মাথা’। আলিপুর আদালতে সৌরভকে ‘বাঁচানোর জন্য’ রাতারাতি কী ভাবে হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছিল, তা আদালতে তুলে ধরেছে পুলিশ। ধৃত তিন জনকে কাউন্সেলিং করানোর দরকার বলে দাবি করেছিলেন অভিযুক্তদের আইনজীবী। সেই দাবিও মানতে চাননি সরকার পক্ষের আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘‘ধৃতেরাই এই ভাবে প্যান্ট খোলো, উল্টো হয়ে শুয়ে থাকো, এ সব করেছে এত দিন। তাঁদের আবার কি কাউন্সেলিং? এঁরাই তো কাউন্সেলিং করত! মনোতোষের ডায়েরি থেকে অত্যাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরার প্রয়োজন রয়েছে।’’
বিবস্ত্র করে ঘোরানো
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রকে বিবস্ত্র করে হস্টেলের বারান্দায় ঘোরানো হয়েছিল। প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় র্যাগিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে র্যাগিং বিরোধী আইনের ধারা যুক্ত করার কথাও জানিয়েছে পুলিশ। অন্য দিকে, ৯ অগস্ট রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানতে মঙ্গলবার হস্টেলের রাঁধুনিকে লালবাজারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। লালবাজার সূত্রে খবর, হস্টেলের ৭০ নম্বর ঘরে ওই ছাত্রকে বিবস্ত্র করানো হয়েছিল। তার পর তাঁকে বারান্দায় বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয়। কী ভাবে র্যাগিং হয়েছে, তার নথি মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে জমা করেছে পুলিশ।
র্যাগিং বিরোধী আইনে মামলা
৩০২ ধারায় খুন এবং ৩৪ ধারায় সম্মিলিত অপরাধের অভিযোগে আগেই মামলা রুজু করা হয়েছিল। এ বার যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ‘র্যাগিং ইন এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট, ২০০০’ অর্থাৎ, অ্যান্টি র্যাগিং বা র্যাগিং বিরোধী আইনের ধারাতেও মামলা রুজু করার আবেদন করা হবে আদালতে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে এমনটাই। যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুতে প্রথম থেকেই র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সম্প্রতি হস্টেল থেকে একটি নীল রঙের হাফ প্যান্ট এবং গেঞ্জি উদ্ধার করেছে। এক পড়ুয়ার দাবি, ওই পোশাক মৃত ছাত্রের। ৯ অগস্ট ওই ছাত্রকে বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল বলেও অনেকে দাবি করেছেন। যার জেরে গোটা ঘটনায় র্যাগিং-যোগ আরও জোরালো হয়েছিল। মামলার শুনানি চলাকালীন সরকারি আইনজীবী সৌরীন ঘোষালও দাবি করেছিলেন, ‘‘একটা অত্যাচারের গল্প পাচ্ছি।’’ পুলিশ সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে যে, অভিযুক্তেরা নিজেদের ‘বাঁচানোর চেষ্টা’ করছেন। তাঁদের বয়ানে অসঙ্গতিও দেখা গিয়েছে। এক এক জন এক এক রকম বয়ান দিচ্ছেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর।