অসহনীয়: যানবাহনের তীব্র শব্দে কান ঢেকেছে এক খুদে। মঙ্গলবার, ভিআইপি রোডে। ছবি: সুমন বল্লভ
লাগামছাড়া শব্দদূষণ পরোক্ষে ছাপ ফেলছে ব্যক্তিত্বে। পাল্টে দিচ্ছে কথা বলার সহজাত ধরন। কারণ, ‘অ্যাম্বিয়েন্ট নয়েজ়’ বা পারিপার্শ্বিক শব্দের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় উচ্চগ্রামে কথা বলা অভ্যাস করছেন সকলে। শহরের ইএনটি চিকিৎসক এবং মনোবিদদের একটা বড় অংশের পর্যবেক্ষণে এমনটাই ধরা পড়েছে।
ওই পর্যবেক্ষণ থেকে এ-ও জানা যাচ্ছে যে, শব্দদূষণের ক্রমবর্ধমান মাত্রা পরোক্ষে প্রভাব ফেলছে ছোটদের মানসিক গঠনেও। কারণ, পারিপার্শ্বিক শব্দকে ছাপিয়ে নিজের কথা শোনানোর যে প্রাণান্তকর চেষ্টা বড়দের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে তারা, তাতে জোরে কথা বললেই ঠিক কথা বলা যায়, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে তাদের মনে।
আজ, বুধবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শব্দদূষণের এই ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে ইএনটি চিকিৎসক দুলালচন্দ্র বসু বলেন, ‘‘আশপাশে শব্দের মধ্যে নিজেদের কথা শোনানোর জন্য আমরা প্রত্যেকেই আগের থেকে বেশি জোরে জোরে কথা বলছি। শব্দ কম থাকলে এত জোরে কথা বলার প্রয়োজন হত না। কিন্তু শব্দের কারণে কথা বলার সহজাত ধরন পাল্টে যাচ্ছে।’’ আশপাশের শব্দকে ছাপিয়ে যেতে উচ্চগ্রামে কথা বলার অভ্যাস আসলে শব্দদূষণের একটা ‘অশুভ বৃত্ত’ তৈরি করছে বলে মনে করছেন আর এক ইএনটি চিকিৎসক শান্তনু পাঁজা। তাঁর মতে, প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে সেই বৃত্তে ‘অবদান’ রাখছেন। আর জোরে কথা বলতে গিয়ে প্রভাব পড়ছে স্বরযন্ত্রে, ভেঙে যাচ্ছে গলা। শান্তনুবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটাও কিন্তু শব্দদূষণের পরোক্ষ ফল।’’
এর আগে শহরকে চারটি জ়োনে ভাগ করে সেখানে আলাদা আলাদা ভাবে শব্দদূষণের মাত্রা পরীক্ষা করেছিলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জিওগ্রাফি অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড জিওগ্রাফি’ বিভাগের শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ রায়চৌধুরী। এমনিতে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শব্দমাত্রার মাপকাঠি অনুযায়ী, দিনের বেলায় শিল্পক্ষেত্র (ইন্ডাস্ট্রিয়াল), বাণিজ্যিক (কর্মাশিয়াল), আবাসিক (রেসিডেন্সিয়াল) ও সাইলেন্স জ়োনের নির্ধারিত মাত্রা যথাক্রমে ৭৫, ৬৫, ৫৫ ও ৫০ ডেসিবেল। রাতে সেই নির্ধারিত মাত্রা হল যথাক্রমে ৭০, ৫৫, ৪৫ ও ৪০ ডেসিবেল। কিন্তু ইন্দ্রজিৎবাবুর পরীক্ষায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে দিনে ধারাবাহিক ভাবে শব্দমাত্রা ৮৫-৯০ ডেসিবেল বলে ধরা পড়েছিল। ইন্দ্রজিৎবাবুর কথায়, ‘‘সাইলেন্স জ়োন শুধুই খাতায়-কলমে রয়েছে!’’ আর এই শব্দ ছাপিয়ে নিজের কথা শোনানোর জন্য বাচ্চাদের মধ্যেও চেঁচিয়ে কথা বলার প্রবণতা চলে আসছে বলে জানাচ্ছেন ইএনটি চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই তো
প্রায় চেঁচিয়েই কথা বলে। শব্দপ্রাবল্যের মধ্যে থাকতে-থাকতেই এই অভ্যাসটা গড়ে উঠছে।’’
বড়দের জোরে জোরে কথা বলা আবার ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে বলে মনে করছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। কারণ তাঁর বক্তব্য, বাচ্চারা জোরে কথা বলাটাকে ব্যক্তিত্বের ক্ষমতার দ্যোতক হিসেবে দেখে। নীলাঞ্জনাদেবীর কথায়, ‘‘তা ছাড়া সব সময়ে এত শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে বাচ্চাদের মধ্যে একটা অস্থিরতাও কাজ করছে। ক্রমশই শান্ত, নিরিবিলি কোনও জায়গাকে তারা আর নিজের সিস্টেমের মধ্যে নিতে পারছে না।’’ মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘অনেকের মধ্যে ‘নয়েজ় ইনটলারেন্স’ অর্থাৎ শব্দে অসহিষ্ণুতাও কাজ করে। তাই খুব দ্রুত বিরক্ত হয়ে ওঠে অনেক বাচ্চা।’’
বছর চারেক আগে কালীপুজোর সময়ে শহরের শব্দদূষণ নিয়ে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের (এসআরএফটিআই) অ্যাকুস্টিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছিলেন ‘সাউন্ড রেকর্ডিং অ্যান্ড ডিজ়াইন’ বিভাগের প্রধান দেবাশিস ঘোষাল। দেবাশিসবাবু এ বিষয়ে বলছেন, ‘‘এসআরএফটিআইয়ের একটি ক্লাসরুম এমন ভাবে ডিজ়াইন করেছি যেখানে কোনও মাইক্রোফোনের দরকার পড়ে না। কিন্তু বিদেশিরা বক্তৃতা করতে এলে অসুবিধা হয়। কারণ তাঁরা খুবই আস্তে কথা বলেন। তখন আমাদের এগিয়ে গিয়ে বসতে হয়। অর্থাৎ আমরা শুধু জোরে কথা বলতেই নয়, জোরে শুনতেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।’’ কারণ? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অভিজিৎ মজুমদার বলছেন, ‘‘আশপাশের শব্দপ্রাবল্যের কারণে কথা বলার ফ্রিকোয়েন্সি লেভেল ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। ফলে আগে যে ফ্রিকোয়েন্সি লেভেলে শুনতে পেতাম, সেটায় আর শুনতে পারছি না।’’
এ ভাবেই শব্দদূষণ তৈরি করে তুলছে জোরে কথা বলার এক সংস্কৃতি, যেখানে ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকেই হয়ে উঠছেন শব্দদূষণের ছোট-ছোট ইউনিট! এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।