যাত্রা: কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপের পথে গণেশ মূর্তি। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
‘প্রভাবশালীদের’ নাম ব্যবহার করে চাঁদার জুলুমের অভিযোগ তো রয়েইছে। এ বার গণেশ পুজোর প্রাক্কালে শব্দতাণ্ডবের অভিযোগও উঠছে শহর জুড়ে। মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ হয়নি, অথচ পাড়ায় পাড়ায় মাইক বেঁধে চলছে পুজোর নির্ঘণ্ট এবং অনুষ্ঠানের শিল্পীদের নাম ঘোষণা থেকে নানাবিধ প্রতিযোগিতার দিনক্ষণ ঘোষণা। বাকি সময়ে ডেসিবেলের তোয়াক্কা না করেই তারস্বরে বাজানো হচ্ছে গান। কোথাও কোথাও আবার শব্দবিধি উড়িয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ডিজে, সাউন্ড বক্স বাজিয়ে চলছে জলসা।
অনুমোদনহীন ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও চাঁদার বিলে ও পোস্টারে মেয়র-বিধায়কের নাম লিখে গণেশ পুজোর নামে চাঁদা তোলা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে সল্টলেকে। এ বার মাইকের দাপটের অভিযোগ উঠেছে শহর জুড়েই। অবস্থা এমনই যে, পুজোর দিন তিনেক আগে থেকেই শব্দদানবের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন শহরবাসীর একাংশ। উল্টোডাঙার এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘পরীক্ষার আগে ছেলেকে যে একটু বই নিয়ে বসাব, তার উপায় কোথায়? দুর্গা, কালী নিয়ে মেতে থাকা বাঙালি কী ভাবে হঠাৎ গণেশভক্ত হয়ে গেল, বুঝছি না। প্রতি বছরই এই দাপট বাড়ছে।’’
নিউ আলিপুর, কসবা, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড থেকে উল্টোডাঙা, লেক টাউন— উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্রই শব্দতাণ্ডবের ছবিটা প্রায় এক। কোথাও পুজোর দু’দিন, কোথাও তিন দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল তারস্বরে মাইক বাজানোর অত্যাচার। এমনকি, বহু জায়গায় মধ্যরাত পর্যন্ত জলসার নামে সাউন্ড বক্স, ডিজে বাজানোর অভিযোগও উঠছে।
পুজোর দিনকয়েক আগে থেকেই এ ভাবে মাইকের দাপট বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শহরের বাসিন্দাদের একাংশ। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরে শহরে গণেশ পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমকও ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। নিউ আলিপুরের বাসিন্দা অমিয় পাত্র বলছেন, ‘‘যে পাড়ায় আগে কিছুই হত না, এখন সেখানেই ঘটা করে গণেশ পুজো হচ্ছে। কোথাও আবার একই পাড়ায় দুই দাদার নিয়ন্ত্রণে দুটো পুজো। নিয়ম ভাঙাতেও যেন প্রতিযোগিতা।’’
ইদানীং শহরে গণেশ পুজোর এই দাপট বৃদ্ধির কারণ কী? কলকাতায় কি আগে এত গণেশ পুজো বা সেই পুজো ঘিরে শব্দদানবের এমন দাপট ছিল? পুরাণ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সমাজতাত্ত্বিক— সকলে এই দাপটের পিছনে রাজনীতিকেই অনেকাংশে দায়ী করছেন। এমনকি, রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে গেলে এই দাপট আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন তাঁরা। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, ‘‘বঙ্গদেশে আলাদা করে গণেশ পুজো হত না। মণ্ডপ বেঁধে কলকাতায় গণেশ পুজোর দাপট শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। এটা একেবারেই সাম্প্রতিক ও ভিন্ রাজ্য থেকে আমদানি। এর পিছনে একটি বড় অংশ জুড়ে রাজনীতি কাজ করছে।’’ এমনকি, এর জন্য দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর প্রাধান্য কমতে পারে বলেও মত তাঁর।
সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র আবার ইদানীং বাঙালির সংস্কৃতিতে ধনসম্পদ প্রার্থনা করার বাড়বাড়ন্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনকেও দায়ী করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতিতে যেমন ভিন্ রাজ্যের সংস্কৃতির আমদানি ঘটেছে, তেমনই সমান্তরাল ভাবে সেই সংস্কৃতিকে বঙ্গে নিয়ে আসারও চেষ্টা হচ্ছে। আগে বাংলায় গণেশ পুজো হত মূলত বাড়িতে এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। মুম্বইয়ে বড় করে পুজো হলেও কলকাতায় তেমন হত না। আসলে বাঙালির সংস্কৃতিতে ধনসম্পদ-প্রার্থনা কখনওই সামনে আনা হত না। কিন্তু এখন তা প্রকাশ্যে আসছে। কখনও ধনসম্পদ প্রাপ্তির আশায়, আবার কখনও রাজনীতির জাঁতাকলে গণেশ পূজিত হচ্ছেন।’’