অ-সচেতন: (বাঁ দিকে) পথে সিগারেট খাওয়ার জন্য মাস্ক নেমেছে থুতনিতে। এসপ্লানেডে। (ডান দিকে) বৌবাজারে মাস্ক ছাড়াই চলছে ধূমপান। সোমবার। নিজস্ব চিত্র।
মাস্ক নেমেছে থুতনিতে। আর সেই অবস্থায় সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তি। ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তায় মাস্ক খুলে ধূমপান করছেন?’’ প্রশ্ন করতেই উত্তর— ‘‘মাস্ক না খুললে সিগারেট খাব কী করে!’’
সোমবার, বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবসে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গেল এমন ছবি, যাতে চিন্তিত চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ‘‘রাস্তায় মাস্ক খুললে এমনিতেই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। তার উপরে ধূমপানে ফুসফুস আরও দুর্বল হচ্ছে, যা কোভিডে অত্যন্ত বিপজ্জনক।’’ বক্ষরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘ দিন ধরে ধূমপান করার ফলে অনেকেরই ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবেশ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরোনোর যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা ব্যাহত হয়। অ্যাকিউট সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ়)-তে আক্রান্ত রোগীর শরীরে এমনিতেই অক্সিজেনের মাত্রা থাকে ৮৮-৯২ শতাংশ। ফলে তাঁরা সংক্রমিত হলে তা রীতিমতো দুশ্চিন্তার ব্যাপার।
তামাক বর্জন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে যেখানে মাস্কে মুখ ঢাকতে বলা হচ্ছে, সেখানে কিছু মানুষ তা খুলে রাখছেন। সঙ্গে ফুসফুসের ক্ষতি করতে ধূমপান করছেন। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি দু’টি বিপদকে একসঙ্গে নিয়ে চলছেন।’’ গৌতমবাবু আরও জানাচ্ছেন, সিগারেটের ধোঁয়ায় অত্যধিক পরিমাণে
কার্সিনোজেন থাকে, যা ধোঁয়ার মাধ্যমে মুখ, শ্বাসনালি হয়ে ফুসফুসে ঢুকছে। ওই কার্সিনোজেনের কারণেই ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সিগারেটে টান মারার ফাঁকেই ধূমপায়ীরা সেই বিষাক্ত
কার্সিনোজেন মিশ্রিত থুতু যত্রতত্র ফেলছেন, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। গৌতমবাবু আরও জানাচ্ছেন, অত্যধিক ধূমপানের কারণে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। ছেলেদের মধ্যে সেই সংখ্যা বেশি হলেও বাদ নেই মেয়েরাও। তাঁরা পরিবেশ দূষণ এবং অন্য ধূমপায়ীর থেকেও আক্রান্ত হচ্ছেন।
আবার করোনায় সংক্রমিত হয়ে যত সংখ্যক রোগী সঙ্কটজনক হচ্ছেন, তাঁদের একাংশ কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ওই রোগীর ফুসফুস আগে থেকে কতটা সুস্থ রয়েছে, তার উপরেই জীবন-মরণ নির্ভর করছে বলে জানাচ্ছেন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের বক্ষরোগ চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘ধূমপানের কারণে যে রোগীর ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে গিয়েছে, কোভিড সংক্রমণে তাঁর ফুসফুস আক্রান্ত হলে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেকটাই বেশি থাকছে।’’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, সিগারেট খেতে মুখ থেকে মাস্ক সরানোর একাধিক ঝুঁকি রয়েছে। যেমন, মাস্কটি সামনে থেকে হাত দিয়ে খোলার ফলে হাতটি সংক্রমিত হয়ে, পরে তা থেকে ভাইরাস চোখ-মুখ-নাকের মাধ্যমে শরীরে ঢোকার সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, মাস্ক থুতনিতে বা গলায় ঝুলিয়ে রাখায় ভাইরাস সহজেই মাস্কে চলে যাচ্ছে। আর এ সবের সঙ্গে বড় বিপদ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে ধূমপান।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, করোনা আক্রান্ত যে রোগীর ফুসফুসের সুস্থতা আগে থেকেই কম, তাঁরা তুলনায় বেশি দিন ভুগছেন, বেশি দিন হাসপাতালে থেকে অক্সিজেনও বেশি লাগছে। পাশাপাশি, ওই সমস্ত রোগীর ‘রেসপিরেটরি ফেলিয়োর’ (শ্বাসযন্ত্র বিকল) হওয়ার আশঙ্কাও অধিক। কিন্তু তার পরেও অনেকে ধূমপান ছাড়তে পারছেন না বলে আক্ষেপ চিকিৎসকদের একাংশের। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে জরিমানা বা শাস্তির নিদান থাকলেও তা কতটা বাস্তবায়িত হয়, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলেও জানাচ্ছেন গৌতমবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আইন থাকলেও তা কড়া ভাবে প্রয়োগ করা হয় না। গাড়ি চালানোর সময়ে ধূমপান বন্ধ করাটাও প্রয়োজন।’’
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের মতে, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, এটা বহু দিন
ধরেই জানা। আবার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তাও সকলে জেনেছেন। কিন্তু তার পরেও গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে অবাধ ধূমপান করার বিষয়ে অরুণাংশুবাবুর মন্তব্য, ‘‘এ তো জেনেশুনে বিষপান করা হচ্ছে।’’