প্রশিক্ষণ: আত্মরক্ষার পাঠ দিচ্ছেন অরূপ দাস। মঙ্গলবার, কলকাতা পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
‘‘মারার সময়ে কোনও কৃপণতা নয়! কেউ তোমার যৌন হেনস্থা কিংবা ধর্ষণের চেষ্টা করতে এলে তাকে কোনও রেয়াত নয়।’’
মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছেন জংলা টি শার্ট, প্যান্ট পরা যুবক। অনেকটা ধমকে আদেশের সুরে চলছে সেই চিৎকার। কলকাতা পুলিশের অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে শনিবার সকাল থেকে বছর ঊনচল্লিশের যে যুবককে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে, তিনি কলকাতা পুলিশের ‘তেজস্বিনী’-র প্রশিক্ষক অরূপ দাস। ২০০৪ সালে ব্যাটেলিয়নে যোগ দেওয়া কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল। বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ট্রেনিং স্কুলের ‘মার্শাল আর্ট’-এর প্রশিক্ষক।
তবে তাঁর পরিচয় এই জায়গাতেই শুধু আটকে নেই। গত ছ’বছর ধরে কলকাতা পুলিশের ট্রেনিং স্কুলে যোগ দিতে আসা নির্বাচিত প্রার্থীদের মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি কোন্নগর এলাকার এবং বস্তির মেয়েদের নিয়মিত আত্মরক্ষার পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন। সেই প্রশিক্ষণের পুরোটাই চলে বিনামূল্যে! ‘‘মেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনও পয়সা নিই না। আমার লক্ষ্য মেয়েদের আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে সাহায্য করা। বিপদে পড়লে যাতে তাঁরা কারও সহযোগিতা ছাড়া নিজেই প্রতিপক্ষকে কাবু করতে পারেন, সে জন্য তাদের তৈরি করাই আমার লক্ষ্য।’’ মঙ্গলবার সকালে তেজস্বিনীর প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরে এ কথা জানালেন অরূপ।
তবে নিখরচায় মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়ার পিছনে রয়েছে তাঁর ছোটবেলায় নিজের দিদিকে চোখ-মুখে নানা আঘাত নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে দেখার স্মৃতি। বালকের মন বুঝত না, সকাল হলেই দিদির চোখের নীচে কালশিটে দাগ বা মুখে আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে এল। জিজ্ঞাসা করলে বছর দশেকের ভাইকে এড়িয়েই যেতেন দিদি। যদিও একটা বয়সের পরে সেই বালক নিজেই বোঝে, তার দিদি আসলে রোজকার গার্হস্থ্য-হিংসার শিকার!
আবার পাড়ারই এক তরুণীকে দেখেছিলেন, দিনের পর দিন স্বামীর মার সহ্য করতে না পেরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আত্মঘাতী হতে। ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলি অরূপের মনে দাগ কেটে দিয়েছিল। তাই যখন বড় হয়ে মার্শাল আর্টে ‘ব্ল্যাক বেল্ট’ হন, তখনই যুবক অরূপ স্থির করে নিয়েছিলেন যে আত্মরক্ষার পাঠ দিয়ে মেয়েদের দৃঢ় করতেই হবে।
অরূপের সেই স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে বছর তিনেক আগে। কলকাতা পুলিশের ব্যাটেলিয়ন থেকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে যোগ দেওয়ার পরে সপ্তাহ শেষে মেলে ছুটি। কিন্তু রবিবারের সেই ছুটি উপভোগ করতে তিনি বাড়ি যান না। সে দিন কোন্নগরে চলে মেয়েদের নিখরচায় তাইকোয়েন্ডো, কিক-বক্সিং এবং ক্যারাটের প্রশিক্ষণ। আর সেই স্কুলের বেশির ভাগ মেয়েই আসে স্থানীয় বস্তি থেকে। অরূপের কথায়, ‘‘নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির দু’বেলা খাবারের চিন্তা করতেই সময় কেটে যায়। সেখানে টাকা খরচ করে পরিবার তাদের প্রশিক্ষণে ঢোকাবে কী করে!’’
অরূপের সেই চেষ্টা অবশ্য বিফল হয়নি। গত তিন বছরে জাতীয় স্তরে সোনার মেডেল ছিনিয়ে এনেছে তাঁর এই স্কুলের মেয়েরাই। রয়েছে ‘ব্রাউন বেল্ট’-এর অধিকারী মেয়েও। তবে এখানেই সন্তুষ্ট নন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে পাঁচ থেকে ষাট— কোনও মেয়ে নিরাপদ নয়। ওই বয়সের যে কেউ হতে পারেন যৌন হেনস্থা কিংবা ধর্ষণের শিকার! আমি চাই তেমন কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই যেন মেয়েরা তা নিজেরাই রুখে দিতে পারেন।’’ তিনি আরও মনে করেন, বর্তমান সময়ে বাবা-মায়ের উচিত মেয়েকে নাচ-গানের পাশাপাশি আত্মরক্ষার পাঠ শেখানো। যাতে পথেঘাটে যে কোনও সময়ে বিপদে পড়লেই নিজেকে বাঁচাতে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষকে মেরে ধরাশায়ী করতে পারেন তাঁরা।
কলকাতা পুলিশের তেজস্বিনীর আড়াইশো মেয়েদের আত্মরক্ষা দেওয়ার পাঠে অরূপের পাশে রয়েছেন তাঁর কোন্নগরের স্কুলের মেয়েরাও। সেই দলে রয়েছে খুদে মেয়ে প্রশিক্ষকও। সেনসেই-এর পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছেন তাঁর মেয়েরাই— ‘‘মারার সময়ে জোর কোথায়?’’