লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে যেমন বাড়ির সঙ্গে লন বা বাগান রাখা বাধ্যতামূলক, আমাদের এ শহরে তা নয়। তবু যোধপুর পার্কে এখনও বেশ কিছু গাছপালা আছে। আয়লা ঝড়ে কিছু উৎপাটিত হলেও আছে। দু’টি পার্ক আছে, তার একটিতে আছে জলাশয়। আবার এই জলাশয়ের একটি ধারে আছে অনভিপ্রেত ঝুপড়ি, যা থেকে জলে প্রচুর দূষণ ছড়ায়। আর উত্তর দিকে রয়েছে দক্ষিণের বিখ্যাত রবীন্দ্র সরোবর। সব পল্লির মতোই এখানেও রয়েছে বিশাল বস্তি এলাকা, যা যোধপুর নামে খ্যাত। অবস্থান হিসেবে যোধপুর পার্ক চমৎকার। এক দিকে রাজা সুবোধ মল্লিক রোড বা গড়িয়াহাট রোড সাউথ, অন্য দিকে আনোয়ার শাহ। পাড়ার গা ঘেঁষেই সাউথ সিটি মল এবং দক্ষিণাপণ।
এই পাড়ায় আমার তিরিশ বছরেরও বেশি কেটে গেল।
এখানে কখনও রাজনৈতিক মারপিট বা বড় ধরনের হাঙ্গামা কিছু দেখিনি। ভোটের সময়েও না।
শান্তিপূর্ণ এলাকার তকমা যোধপুর পার্ক পেতেই পারে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইও বিরল। যখন কলেজে পড়তাম তখন যোধপুর পার্ক ছিল ফাঁকা, জলা ও আগাছায় ভর্তি।
পরে পয়সাওয়ালা বাঙালিরা এখানে বসতি শুরু করে। ফ্ল্যাটবাড়ি বা বহুতল নয়, নিজস্ব স্বতন্ত্র বাড়ি। এখন দিন পাল্টাচ্ছে, বাড়ি ভেঙে বহুতল হচ্ছে, ভিড়ও একটু একটু বাড়ছে। আগের মতো নিরিবিলি পরিবেশটা হারিয়েই যাবে হয়তো। তবু বলতে হবে এত চওড়া, বৃক্ষবহুল রাস্তাঘাট খুব কম পাড়াতেই আছে।
যোধপুর পার্কের কলঙ্ক হল এর বাজারটি, এখনও টিনের চালওয়ালা দোকানঘর এবং খোলা আকাশের নীচে গেঁয়ো বাজার। সুপার মার্কেট হবে বলে কবে থেকে শুনে আসছি, টালবাহানায় আজও হল না, একটুখানি হয়ে পড়ে আছে। পরিবেশের জন্য ক্রেতার অভাব, বিকিকিনির মন্দা। যাদের পয়সা আছে তারা রিলায়্যান্স, স্পেন্সার্স, গড়িয়াহাট বা লেক মার্কেটে যায়।
আগে প্রবল বৃষ্টিতে জল জমে যেত খুব। এমনকী হাঁটু জলও দাঁড়িয়ে যেত। এখন অবশ্য সে সমস্যা বিশেষ নেই। জল জমে গেলেও খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। তবু জলনিকাশি ব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া দরকার। আর বর্জ্য ফেলার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রটিরও প্রয়োজন আছে। কারণ ডাকঘর এবং গার্লস স্কুলের সঙ্গেই বিশাল জায়গা জুড়ে বড় রাস্তায় যে ভ্যাট আছে, তা নিয়মিত পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও কিছু দূষণ ছড়ায়। আর ঠিক অরবিন্দ সেবা কেন্দ্রের পিছনের রাস্তায় একটি বিধিবহির্ভূত বর্জ্যস্থান তৈরি হয়েছে। যা প্রবল অস্বস্তিকর। এটিকেও উচ্ছেদ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আরও কয়েকটি এ
রকম বর্জ্যস্থান আছে যা পল্লির পক্ষে শোভন নয়।
যোধপুর পার্কে অনেকে বাড়ির সামনে ফুটপাথের খানিকটা জুড়ে মিনি বাগান করেছেন বা গাছপালা লাগিয়েছেন। ফলে ফুটপাথের পথ ছেড়ে পথচারীদের রাস্তায় হাঁটতে হয়। তাতে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেন না, কারণ বৃক্ষরোপণ এক মহৎ কাজ। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, ফুটপাথ দখল করতে দেওয়াল তুলেছেন। এটি শোভন তো নয়ই। বৈধও নয়। গাছপালা লাগানো এক কথা, কিন্তু দেওয়াল তুলবেন কেন?
আর একটি ব্যাপারও ভেবে দেখা দরকার। ফুটপাথ দখল করে মন্দির বানানোও একটি অনৈতিক ও অবৈধ কাজ। মন্দির তৈরি করতে গেলে তা বৈধ পন্থাতেই হওয়া উচিত। ধর্মাচরণের মধ্যে যদি শোভনতা, শালীনতা, সংযম ও রুচিবোধের প্রকাশ না থাকে, তা হলে তা সঠিক ধর্মাচরণ নয়। ফুটপাথ দখল করে অবৈধ মন্দির বানানোর মধ্যে ভক্তির চেয়ে ব্যবসাবুদ্ধির প্রকটতাই বেশি।
এই এলাকায় দীর্ঘকাল বাস করে জায়গাটার উপরে একটা মায়া পড়ে গেছে। এখানকার ভালমন্দগুলোর সঙ্গে নিজেকে অনেকটা একাত্ম মনে হয়। তবে বসবাসকালে একটি জিনিসের খুব অভাব লক্ষ করেছি। তা হল, খেলার মাঠ। তালতলার মাঠ, ইইডিএফ-এর পিছনে ছোট্ট মাঠটা আর দক্ষিণাপণের পিছনের পার্ক, এ ছাড়া পাড়ার ছেলেদের খেলার জায়গা নেই। ছুটির দিনে অগত্যা তারা রাস্তাতেই ব্যাটবল খেলে।
যোধপুর পার্কের অধিবাসীদের টাকা বেশি কি না তা জানি না, তবে এ পাড়ায় অগুনতি ব্যাঙ্ক। বড় রাস্তা থেকে শুরু করে নানা অলিগলিতেও সরকারি, বেসরকারি ব্যাঙ্ক আর এটিএম-এর ছড়াছড়ি। কাছাকাছি সাউথ সিটির স্টারমার্ক ছাড়া এখানে ভাল বইয়ের দোকান কিন্তু নেই। লেকটা কাছেই। গোবিন্দপুরের রেলগেট পার হলেই লেক। স্বাস্থ্যান্বেষীদের এতে খুবই সুবিধে হয়েছে। আছে গোটা দুই জিম। কয়েকটি বাঁধা আড্ডার জায়গাও রয়েছে। রেসিডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পূজামণ্ডপের পাশে ক্লাবঘরে, মোড়ের গাছতলায় এবং বাজারের কাছেপিঠে।
আমার মনে হয়, বসবাস করার পক্ষে যোধপুর পার্ক এখনও বেশ চমৎকার একটা জায়গা। কলকারখানা নেই, তেমন ধুলো ধোঁয়া নেই, কোলাহল নেই, ভিড় নেই, পরিবেশ এখনও অনেকটাই নিরিবিলি। জানলা দিয়ে তাকালে গাছভরা কাঠচাঁপা আর রঙ্গন ফুল দেখতে পাই। পাড়াটা তেমন ঘি়ঞ্জিও নয়। ভোরবেলা বুড়ো মানুষরা যখন টি-শার্ট, হাফ প্যান্ট আর কেডস পরে হাঁটতে এবং ‘যৌবন’ দেখাতে বেরোন, তখনও আমার বেশ ভালই লাগে। মানুষের কত কী দেখানোর এবং দেখার আছে। চুপিচুপি আর একটা খবরও দিয়ে রাখি, কলকাতার সবচেয়ে সুন্দরী মধ্যবয়স্কা মহিলাদের বাস কিন্তু এই যোধপুর পার্কেই।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।