ফাইল চিত্র।
করোনা-কালে লকডাউনের জন্য কার্যত তালা পড়ে গিয়েছে সোনাগাছির অন্দরে। ছোঁয়াচ এড়ানোর ভয়ে এক প্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছে যৌনকর্মীদের ব্যবসা। রোজগার না-থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কলকাতা এবং শহরতলিতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করা এমন বেশ কয়েক হাজার মেয়ের খোঁজই এখন মিলছে না। তাঁরা কোথায় এবং কী অবস্থায় আছেন, সেটাই এই মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সোনাগাছির।
শোভাবাজার চত্বরে এশিয়ার সব চেয়ে বড় যৌনপল্লি তালাবন্দি হয়ে গিয়েছিল সেই মার্চেই। শহর এবং জেলাগুলিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন জানাচ্ছে, ওই সব মেয়েদের অনেকেই ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ‘ফিরে যাওয়া’ ওই সব যৌনকর্মী এবং তাঁদের সন্তানদের চিন্তাই আপাতত ভাবিয়ে তুলেছে তাঁদের।
সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে স্মরজিৎ জানা জানাচ্ছেন, কলকাতায় সোনাগাছি, কালীঘাট, চেতলা, বৌবাজার, খিদিরপুরের লখার মাঠ এলাকায় তাঁদের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৬ হাজার যৌনকর্মীর মধ্যে চার-পাঁচ হাজার মেয়ের সঙ্গেই এখন আর যোগাযোগ নেই। ওই মেয়েরা লকডাউনের আগে অথবা আনলক পর্বের শুরুতে কোনও ভাবে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। রোজগার না-থাকায় হোমে থেকে লেখাপড়া করা ছোট ছেলেমেয়েদেরও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কারও বাড়ি মুর্শিদাবাদ, কারও মছলন্দপুর, সিউড়ি বা সুন্দরবন। কিন্তু এখন তাঁরা কেমন আছেন, পেট চালাতে কী করছেন, তা জানতে পারেননি সংস্থার কর্মীরা। স্মরজিৎবাবুর কথায়, ‘‘ওঁদের সম্পর্কে অন্যদের থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চলছে। যাঁদের ঠিকানা জানা আছে, তাঁদের বাড়িতে দল পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু যত দিন না ট্রেন চালু হয়, তত দিন পর্যন্ত সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।’’
প্রথমত ব্যবসা বন্ধ এবং দ্বিতীয়ত, অন্য পেশায় যাওয়ার উপায় ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না-থাকায় করোনা-পর্বে এমনিতেই অথৈ জলে কয়েক হাজার যৌনকর্মী। সেই সঙ্গে রয়েছে যোগাযোগ করতে না-পারা মেয়েদের নিয়ে চিন্তা। স্মরজিৎবাবু বলছেন, ‘‘লকডাউনে
এইচআইভি আক্রান্ত মেয়েদের ওষুধ পেতে সমস্যা হচ্ছিল। যাঁরা ফিরে গিয়েছেন, তাঁদের কেউ এইচআইভি আক্রান্ত থাকলে তিনি এখন কেমন আছেন জানা নেই। এ ছাড়া নতুন জায়গায় গিয়ে স্বাস্থ্য-বিধি না মেনে কাজ শুরু করে দিলে তাতে সেই যৌনকর্মীর নিজেরই এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার বা সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় রয়েছে।’’
লকডাউনে বাড়ি বা অন্যত্র গিয়ে আটকে পড়া যৌনকর্মীরা যে এখন গার্হস্থ্য হিংসার শিকারও হতে পারেন, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা আর একটি সংগঠনের প্রধান ঊর্মি বসু। তাঁর মতে, আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় পরিবারে নির্যাতন করা হতে পারে ওই যৌনকর্মীদের।
আর পাচার? উপার্জনের লোভ দেখিয়ে এই মেয়েদের কি ভিন্ রাজ্যে পাচার করে দেওয়া সম্ভব? সেই আশঙ্কা উড়িয়ে না-দিয়ে ঊর্মি বলছেন, ‘‘মেয়েটি কতটা বিচক্ষণ বা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন, তার উপরে এটা নির্ভর করছে। তবে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ফের বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা হতেই পারে।’’ কলকাতা এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে পাচার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার তরফে বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়ের আবার ব্যাখ্যা, শুধু ফিরে যাওয়া মেয়েরাই নন, রোজগার না-থাকায় যৌনপল্লি থেকেও মেয়ে বিক্রির আশঙ্কা এই মুহূর্তে অনেক বেশি। সেই সঙ্গে পাচার হয়ে যেতে পারে যৌনকর্মীদের সন্তানেরাও। বৈতালির কথায়, ‘‘পড়াশোনা ছাড়িয়ে যে সন্তানদের নিয়ে গিয়েছেন যৌনকর্মী মায়েরা, তাদের জীবন ওলটপালট হয়ে যেতে বসেছে। ওই কিশোরীদের এখনই পাচার করার চেষ্টা করতে পারে পাচারকারীরা। লকডাউনের সময়ে রাজ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। যা আদতে পাচারের আশঙ্কাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।’’