এলাকায় পড়ে ভাঙা মদের বোতল। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানে চলে সাট্টার আসর। শনিবার, নাজিরগঞ্জে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
হাওড়ার নাজিরগঞ্জের নেপালি পাড়ায় প্রতিবাদী ব্যবসায়ী রবি রাইকে খুনের ঘটনায় ধৃতদের ১২ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল হাওড়া আদালত। খুনের এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শুক্রবার এলাকারই বাসিন্দা দুই যুবক, শিবা ছেত্রী ও শত্রুঘ্ন রজককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। শনিবার তাদের আদালতে তোলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই ঘটনায় আরও কয়েক জন জড়িত এবং তাদের পিছনে এক জন বড় মাথা রয়েছে। নিহতের পরিবার ও এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, খুনের ঘটনাটি পূর্ব-পরিকল্পিত। কারণ, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ধৃতদের বার বার ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে অকুস্থলের কাছে। তাঁদের আরও দাবি, ঘটনাস্থলের পাশেই রয়েছে একটি ক্লাব। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীকে অভিযুক্তদের এক জন হুমকি দিয়ে বলেছিল, তিনি যেন সমস্ত আলো ও সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন।
খুনের এই ঘটনা সম্পর্কে এ দিন হাওড়া সিটি পুলিশ আবার অন্য রকম দাবি করেছে। তাদের বক্তব্য, খুনের ঘটনাটি পূর্ব-পরিকল্পিত নয়। ঘটনার রাতে দু’পক্ষই মত্ত অবস্থায় ছিল। রবির সঙ্গে অভিযুক্তদের বচসার জেরেই তাঁকে রাগের মাথায় খুন করা হয়েছে। হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। ফরেন্সিক পরীক্ষাও হয়েছে। আরও কেউ ঘটনায় জড়িত থাকলে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে।’’
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে স্কুটার চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে এলাকার একটি সঙ্কীর্ণ গলির মধ্যে নৃশংস ভাবে খুন হন ৪২ বছরের রবি। তাঁর শরীরে ১৮টি কোপানোর ক্ষত মিলেছে। খুনের পরে রবির মোবাইলটি পাশের পুকুরে ফেলে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে। এলাকায় ভাল মানুষ বলে পরিচিত রবির খুনের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শুক্রবার রাতেই পাড়ার মহিলারা অভিযুক্ত শত্রুঘ্নের বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর চালান। শনিবারও মদ-জুয়ার আসর বসানোর বিরোধিতায় বিক্ষোভ দেখান বাসিন্দারা।
এ দিন দুপুরে নেপালি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পরিস্থিতি থমথমে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাসিন্দাদের জটলা। তাঁরা জানালেন, সব মিলিয়ে পাঁচটি দেশি মদের বেআইনি ঠেক চলে ওই এলাকায়। যার মধ্যে একটি বড় ঠেক চালান অভিযুক্ত শিবা ছেত্রীর মা। অন্যান্য ঠেকও শিবাই চালাত। সেই সঙ্গে এলাকায় সাট্টারও কারবার চালাত ওই যুবক। এমনকি, এক সাট্টার দোকানেই নাকি রাতে সে ঘুমোত। রবি শিবার এই সমস্ত কাজকর্মের প্রতিবাদ করায় দু’জনের মধ্যে প্রায়ই গোলমাল হত। মাসখানেক আগে পুলিশ শিবার সাট্টার দোকানটি বন্ধ করে দেয়। এর পরেই রবির সঙ্গে শিবার শত্রুতা চরমে ওঠে।
এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, সরস্বতী পুজোর দিন পরিকল্পিত ভাবেই রবিকে খুন করেছে শিবা ও তার দলবল। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি শিবমন্দির লাগোয়া ক্লাবের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে শিবা ও শত্রুঘ্ন সেখানে ঘোরাঘুরি করছিল। এমনকি, ফেরার পথে রবিকে আটকাতে রাস্তার দু’পাশে একটি বাঁশও আড়াআড়ি ভাবে ফেলে রেখেছিল তারা। ‘শিবমন্দির সেবা সমিতি’ নামে ওই ক্লাবের সম্পাদক মদন থাপা বলেন, ‘‘সাময়িক রাগের বশে রবিকে খুন করা হয়নি। ওঁকে পরিকল্পনা করে খুন করার জন্যই রাত সাড়ে ১১টা থেকে দু’জনকে হাতে কিছু একটা নিয়ে ওই গলিতে বার বার ঘুরতে দেখা গিয়েছে।’’ ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী কিশোর যশোহরা বলেন, ‘‘সেই রাতে সাড়ে ১১টা নাগাদ ক্লাবে এসে শত্রুঘ্ন হুমকি দিয়ে আমাকে বলেছিল, সমস্ত আলো ও ক্যামেরা বন্ধ করে দিতে। তখনও বুঝতে পারিনি যে, রাতে ওরা রবিদাকে খুন করবে বলে ওই কথা বলছে। যদিও আমি ক্যামেরা বন্ধ করিনি।’’
উলুবেড়িয়ার ঘটনার পরে নাজিরগঞ্জে ফের একই ধরনের ঘটনা ঘটায় বেআইনি মদের ঠেকের রমরমা ও সাট্টা-জুয়ার অবাধ কারবার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন বলেন, ‘‘হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ ও হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটকে আরও সক্রিয় হতে হবে। কোথায় কোথায় মদ ও সাট্টার ঠেক চলছে, তা খুঁজে বার করে তুলে দিতে হবে। আবগারি দফতরকে বলব, অবিলম্বে ওই সব ঠেকে হানা দিয়ে সেগুলি বন্ধ করে দিতে।’’