—প্রতীকী চিত্র।
প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপরে পেল্লায় সব ভবন। খেলার মাঠ, প্রার্থনার জায়গা, বিশাল ঘরে বসে খাওয়ার বন্দোবস্ত! কোনও কিছুরই অভাব নেই। রয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গাড়ি, সর্বক্ষণ সিসি ক্যামেরার নজরদারি। কিন্তু এমন ঝাঁ-চকচকে স্কুল তথা হস্টেলে পড়ুয়া ও আবাসিকদের নিরাপত্তা রয়েছে কি?
হরিদেবপুর থানা এলাকার জোকায় দৃষ্টিহীনদের একটি স্কুল তথা হস্টেলে আবাসিকদের ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠার পরে এমন প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে। দৃষ্টিহীন বা ক্ষীণ দৃষ্টির ছেলেমেয়েদের অভিভাবকেরা তো বটেই, সচেতন নাগরিকদের অনেকেই জানতে চান, শহরের মধ্যেই এমন স্কুল তথা হস্টেল প্রশাসনের নজর এড়িয়ে দিনের পর দিন চলে কী করে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রেও একাধিক সরকারি দফতরের মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি চলছে। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তা-ব্যক্তিদের বড় অংশই দাবি করেন, নিয়ম মাফিক নজরদারি (ইনস্পেকশন) করতে গেলেও ঝাঁ-চকচকে বন্দোবস্ত দেখেই ফিরে আসতে হয়। ভিতরের কেউ ফাঁস না করলে এমন স্কুলে আদতে কী হচ্ছে, বোঝাই যায় না!
জোকার ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ। লালবাজারের স্পেশ্যাল জুভেনাইল পুলিশ ইউনিট স্কুলটির সব দিক খতিয়ে দেখে তদন্ত করছে। তাতেই জানা গিয়েছে, ওই স্কুলের ছাড়পত্র নিয়ে একাধিক অনিয়ম রয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, এই ধরনের স্কুলের লাইসেন্স দেয় রাজ্য সরকারের গণশিক্ষা প্রসার এবং গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতর। লাইসেন্স পাওয়ার শর্তের মধ্যে রয়েছে, স্কুলভবন থাকতে হবে, নির্দিষ্ট সংখ্যক দৃষ্টিহীন বা ক্ষীণ দৃষ্টির পড়ুয়া থাকতে হবে। চাই পর্যাপ্ত শিক্ষকও। প্রথম বার দফতরের তরফে ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখে অনুমতি দেওয়া হয়। তার পরে আরও কয়েক বার ওই স্কুলে পরিদর্শনে যান সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকেরা। তার পরে মেলে লাইসেন্স এবং আর্থিক সাহায্য। কিন্তু জোকার এই স্কুলের এমন কোনও লাইসেন্সই নেই। তবে, এক কালে এই স্কুলের নামে গণশিক্ষা প্রসার দফতর থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ, সেই অনুমতিপত্রকেই স্কুলটিকে সরকারের মান্যতা দেওয়ার শংসাপত্র হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে এখন। কিন্তু স্কুলের সঙ্গে যে হস্টেলও চালানো হবে, তার কোনও উল্লেখ স্কুলের তরফে অনুমতি চেয়ে পাঠানো আবেদনপত্রে ছিল না। অর্থাৎ, কোনও অনুমতি ছাড়াই চলছিল স্কুলের হস্টেল। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গণশিক্ষা প্রসার এবং গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতরের সচিব কৃষ্ণা গুপ্ত জানান, কোনও হস্টেলের অনুমতি তাঁরা দেন না। ওই দফতরের আর এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এই হস্টেল কোনও সরকারি হোম নয়। গোটাটাই বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশি অনুদানে চলছিল। দৃষ্টিহীনদের কোনও বেসরকারি স্কুলের হস্টেলের অনুমতি যে হেতু আমরা দিই না, তাই সেগুলির দায়ও আমাদের নয়।’’
তা হলে দায় কার?
গণশিক্ষা প্রসার দফতর থেকে আঙুল তোলা হয়েছে নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের দিকে। যদিও ওই দফতরের আধিকারিকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, গণশিক্ষা প্রসার দফতর থেকেই যে হেতু অনুমতি দেওয়া হয়, সে হেতু ওই দফতর এবং পুলিশেরই বিষয়টি দেখার কথা। শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘সব ঠিক আছে কি না, বুঝতে নিয়ম করে হোমগুলিতে যাই আমরা। তবে কোনও হস্টেলেই যাওয়া হয় না। তা ছাড়া, কেউ গিয়ে হয়তো বাইরের ঝাঁ-চকচকে ব্যবস্থা দেখেই ফিরে আসতেন। দার্জিলিং, কালিম্পং-সহ বহু জায়গায় এমন প্রচুর স্কুল-হস্টেল চলে। ক’টার খবর বাইরে আসে? গণশিক্ষা প্রসার দফতরেরই এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত।’’
সমাজকল্যাণ দফতরের শিশুকল্যাণ সমিতি বা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কলকাতা জেলার চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর রায় আবার বললেন, ‘‘নির্দিষ্ট তথ্য ছিল, তাই হানা দিয়ে সবটা বার করা গিয়েছে। কিন্তু ভিতরে কী হচ্ছে, তা যদি জানতেই না পারা যায়, তা হলে কী করে কী হবে! মেয়েদের ঘরে তো আর ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়া যায় না! বাবা-মায়েদেরও সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতে হবে। সামান্যতম অন্য রকম কিছু কানে এলে সচেতন ভাবে পদক্ষেপ করতে হবে।’’
এই ঘটনার পরে কি সচেতনতা বাড়বে? এর পরেও কি প্রশাসন ভিতরের লোক খবর ফাঁস করে দেওয়া বা অভিযোগ না আসা পর্যন্ত সেই অপেক্ষাই করে যাবে? কেন আগাম পদক্ষেপ করা হবে না? প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। স্পষ্ট উত্তর মেলে না। (শেষ)