সর্বাঙ্গে কালশিটে, গায়ে ঘা, উদ্ধার ১৩ বছরের কিশোরী

হাড় জিরজিরে বছর তেরোর মেয়েটির চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। গলায় ফোস্কা, ঘায়ের দগদগে কালো দাগ। হাতে-পায়েও কালশিটে। গত শুক্রবার ফুলবাগান থানা এলাকার রামকৃষ্ণ সমাধি রোডের এক ব্যবসায়ীর ফ্ল্যাট থেকে ওই কিশোরীকে এই অবস্থাতেই উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সে ওই ফ্ল্যাটে জায়সবাল পরিবারে পরিচারিকার কাজ করত।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:২৭
Share:

মারধরে ক্ষতবিক্ষত সেই কিশোরী। — নিজস্ব চিত্র

হাড় জিরজিরে বছর তেরোর মেয়েটির চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। গলায় ফোস্কা, ঘায়ের দগদগে কালো দাগ। হাতে-পায়েও কালশিটে। গত শুক্রবার ফুলবাগান থানা এলাকার রামকৃষ্ণ সমাধি রোডের এক ব্যবসায়ীর ফ্ল্যাট থেকে ওই কিশোরীকে এই অবস্থাতেই উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সে ওই ফ্ল্যাটে জায়সবাল পরিবারে পরিচারিকার কাজ করত। সোমবার পুলিশ ওই দম্পতির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। যদিও অভিযুক্ত স্বামী-স্ত্রী তাঁদের ছেলে-সহ পলাতক। ফ্ল্যাটও আপাতত তালাবন্ধ।
শিশু কল্যাণ সমিতি সূত্রের খবর, গত শুক্রবার ফুলবাগান থানার পুলিশ ফোন করে তাদের জানায়, রামকৃষ্ণ সমাধি রোডের একটি ফ্ল্যাট থেকে বছর তেরোর একটি মেয়েকে তারা উদ্ধার করেছে। মেয়েটিকে সেখানে মারধর করা হচ্ছিল। তাকে কোথায় রাখা হবে, তা জানতে চেয়ে পুলিশ ফোন করেছিল। সমিতি মেয়েটিকে হোমে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
কিন্তু তিন দিন পরে সোমবার মেয়েটিকে শিশু কল্যাণ সমিতির সামনে হাজির করানো হলে তাঁরা চমকে যান। মেয়েটিকে দেখে এবং তার বয়ান শুনে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে এফআইআর করার নির্দেশ দেন। বয়ানে মেয়েটি কী জানায়?
সমিতি জানাচ্ছে, মেয়েটি বয়ানে জানিয়েছে, তার বাড়ি ক্যানিংয়ে। আরও ভাইবোন থাকায় দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে বাবা-মা হিমশিম খান। তাই পাড়ার এক জন তার বাবা-মাকে জানায়, কাজের জন্য কলকাতা পাঠালে খাবারের অভাব হবে না। জামাকাপড়ও মিলবে। সঙ্গে বেতন হিসেবে প্রতি মাসে টাকাও পাবে। মেয়েটি জানিয়েছে, বাবা-মা সেই শুনে আপত্তি করেননি। কিন্তু কলকাতায় ওই বাড়িতে কাজে ঢোকার পর থেকেই তার উপরে অত্যাচার শুরু হয়। মিলত না ভরপেট খাওয়াও। সব কাজ করানো হতো। বাড়ি যাওয়ারও ছুটি মিলত না। মেয়েটির আরও অভিযোগ, মারধরের কথা বাইরে না বলার জন্য মালকিন হুমকিও দিত।
কিন্তু যে স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি কিশোরীকে অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা পালালেন কী করে?
সমিতি এ বিষয়ে পুলিশের ভূমিকাকেই দায়ী করেছে। সমিতির কর্তাদের অভিযোগ, জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুযায়ী মেয়েটির বয়ানের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের না করে পুলিশ সাধারণ অভিযোগ দায়ের করেই ছেড়ে দিয়েছিল। তিন দিন পরে সমিতির সামনে হাজির করানো হলে মেয়েটির অবস্থা দেখে তাঁরা পুলিশকে তার বয়ানের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করতে বলেন। ফলে, হাতে তিন দিন সময় পেয়ে ওই দম্পতি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সমিতি মনে করছে, এ সুযোগ হয়েছে পুলিশের অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবেই।

Advertisement

শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা এক সরকারি আধিকারিক জানাচ্ছেন, এই ঘটনায় জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসারের বদলে এক সাব-ইনস্পেক্টরকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার ভার দেওয়া হয়েছিল। তিনি কিশোরীকে উদ্ধার করেন। তার পরে ফোন করে তাদের হাতে মেয়েটিকে তুলে দিয়ে এবং সাধারণ অভিযোগ দায়ের করে দায় সেরেছেন। অথচ শিশু সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, যে থানা মেয়েটিকে উদ্ধার করবে, সেখানকার শিশু সুরক্ষা আইনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসারকে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দিতে হবে। তিনি না থাকলে ডিভিশনের ‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি থানার’ হাতে কেসটি তুলে দিতে হবে। কিন্তু এখানে তা হয়নি। পুলিশের অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবের জন্যই এমন সমস্যা হয়। আর ততক্ষণে অভিযুক্ত পালিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।

ওই আধিকারিক আরও জানান, শিশুদের উপরে নানা ভাবে অত্যাচার বাড়ায় সম্প্রতি ডিভিশনগুলিতে আলাদা করে ‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি থানা’ করা হয়েছে। সেখানে এক জন করে অফিসারকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বার বার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে শিশু সুরক্ষা বিষয়ে একাধিক আলোচনাও করা হয়। কিন্তু অভিযোগ, তার পরেও পুলিশ এমন কাজ করে চলে যাতে শিশু সুরক্ষা বিঘ্নিত হয়। যা এ ক্ষেত্রেও ঘটেছে। যদিও পুলিশ যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, যা করণীয় সেই ভাবেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement