ফাইল চিত্র।
ভাগ্য কিছুতেই প্রসন্ন হচ্ছে না কোভোভ্যাক্সের।
আমেরিকায় তৈরি কোভিডের প্রতিষেধক নোভাভ্যাক্স-কে ‘কোভোভ্যাক্স’ নামে ভারতে তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট। গত বছর নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের প্রথমেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কয়েকটি কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ‘স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন’ (এসটিএম)-এ এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ট্রায়াল চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে ‘ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অব ইন্ডিয়া’ বা ডিসিজিআইয়ের অনুমতি মেলেনি। তাই ট্রায়ালের টাকাও ছাড়তে পারেনি ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’ (আইসিএমআর)। সব মিলিয়ে কোভোভ্যাক্সের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের গোটা পরিকল্পনাই থমকে রয়েছে। ফেব্রুয়ারির আগে সেই কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না গবেষকেরা।
সিরাম-ই ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ-সুইডিশ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার করোনার প্রতিষেধক ‘কোভিশিল্ড’ ভারতে তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে। এবং সেই প্রতিষেধক ইতিমধ্যে দেশে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রয়োগের জন্য ডিসিজিআই ছাড়পত্র দিয়েছে। আবার হায়দরাবাদের সংস্থা ভারত বায়োটেক ও আইসিএমআর এর তৈরি ‘কোভ্যাক্সিন’ করোনার প্রতিষেধক হিসাবে প্রয়োগের অনুমতি পেয়ে গিয়েছে।
ডিসেম্বরেই কলকাতায় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজ়িজ়েস’ (নাইসেড)-এ এই প্রতিষেধকের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আর এক দেশজ টিকা জ়াইকোভ-ডি পরীক্ষামূলক প্রয়োগের তৃতীয় ধাপের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে ডিসিজিআই। এর ট্রায়ালের ক্লিনিক্যাল সাইটের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আটটি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু একমাত্র কোভোভ্যাক্সের পরীক্ষামূলক প্রয়োগেরই কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না।
কোভোভ্যাক্স-কথা
• এটি তৈরি হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে নাম নোভাভ্যাক্স
• এটি প্রোটিন সাব-ইউনিট (ন্যানো পার্টিকল) ভ্যাকসিন
• ভারতে তৈরির দায়িত্বে সেরাম ইনস্টিটিউট
• গবেষকদের দাবি, এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া খুব কম
• ভারতের ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৮টি কেন্দ্রে এর ট্রায়াল হওয়ার কথা। ট্রপিক্যাল তার অন্যতম
• এই প্রতিষেধক মাংসপেশীতে দেওয়া হয়
• তিন সপ্তাহের ব্যবধানে দু’টি ডোজ় নেওয়ার কথা
এই দেরির কারণ কী?
কোভোভ্যাক্সের ট্রায়ালের প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর শান্তনু ত্রিপাঠি বিষদে কিছু না জানালেও মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রস্তুতিগত কারণে দেরি হচ্ছে। ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেলের অনুমতির প্রতীক্ষায় রয়েছি।’’ তবে এসটিএম সূত্রেরই খবর, ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’-এর তরফে সিরাম ইনস্টিটিউটকে ট্রায়াল প্রোটোকলে কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল, আমেরিকায় তৈরি প্রতিষেধকের সঙ্গে ভারতে সিরামের তৈরি প্রতিষেধকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তুল্যমূল্য পরীক্ষা করে দেখা হবে। ট্রায়ালে যোগ দেওয়া প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবককে প্রতিষেধক দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’ জানিয়ে দেয়, স্বেচ্ছাসেবকদের একাংশকে কোনও প্রতিষেধক দেওয়া যাবে না। তাঁদের দেহে সাধারণ জল প্রয়োগ করতে হবে। তার পর দুই দলের প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই করতে হবে। ফলে, প্রোটোকল পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সেটি খতিয়ে দেখে ড্রাগ কন্ট্রোল অনুমতি দিলে তবে আইসিএমআর টাকা দেবে। তার পর এসটিএম প্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করবে, যন্ত্রপাতি কিনবে, কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করবে। অনেক কাজ বাকি।
মোট ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবককে এই প্রতিষেধক দেওয়ার কথা। আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ২৫ জন। এঁদের মধ্যে সিংহভাগ ছিলেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। কলকাতার বেশ কিছু প্রথম সারির চিকিৎসক সেই দলে ছিলেন। ইতিমধ্যে দু’টি প্রতিষেধক ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়ায় এবং চিকিৎসাকর্মীরা প্রতিষেধক পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়ায় সেই চিকিৎসকদের অনেকেই আর কোভোভ্যাক্সের ট্রায়ালে থাকতে চাইছেন না। তাঁরা সরাসরি টিকা নিয়ে নিতে চাইছেন। কারণ, ট্রায়ালে যোগ দিলেই যে প্রতিষেধক পাবেনই সেই নিশ্চয়তা নেই। এমনও হতে পারে যে, যাঁদের দেহে শুধু জল প্রয়োগ করা হচ্ছে তাঁদের দলে তাঁরা পড়ে গেলেন! তার উপর অনেকেই মনে করছেন, সিরাম ইনস্টিটিউট এখন কোভিশিল্ডের উৎপাদন ও বণ্টনের গুরুদায়িত্বে থাকায় কোভোভ্যাক্সের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আপাতত কমতে পারে।
তবে এসটিএমের গবেষকেরাই মনে করছেন, একাধিক প্রতিষেধকের পথ সব সময়ে খোলা রাখা উচিত। কারণ, প্রথমত, কোভিশিল্ড বা কোভ্যাক্সিন ঠিক কতটা কার্যকর হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, এক একটি প্রতিষেধকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক-এক রকম। সেই অনুযায়ী তাদের দামও কমবেশি হবে। বাজারে সব ধরনের দামের প্রতিষেধক থাকা উচিত। ফলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোভোভ্যাক্সের ট্রায়ালের ছাড়পত্র দরকার বলে তাঁদের মত।