মহিলা জেলের মেন গেট। অথচ, সেখানেই সিসিটিভি-র বালাই নেই।
বন্দিদের উপরে নজর রাখার দায়িত্বে যে মহিলা কারারক্ষী রয়েছেন, এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে ওয়ার্ডে খেয়াল রাখার ভার দিয়ে তিনি বসেছিলেন অন্যত্র।
গত ১৮ মার্চ থেকে এ রাজ্যের দু’টি জেলে থাকার পরেও কারা দফতরের কাছে ছবিই নেই পলাতক বাংলাদেশি মহিলা বন্দির।
গত মঙ্গলবার আলিপুর মহিলা জেল থেকে মুন্নি খাতুন নামে ওই বন্দি পালিয়ে যাওয়ার তদন্তে রিপোর্টে বেরিয়ে এল জেলের নিরাপত্তার এমন নড়বড়ে চেহারাটাই। যার জেরে উপর মহলের তদন্তের সামনে জেল কর্তৃপক্ষ বলতেই পারলেন না, কী ভাবে পালিয়ে গিয়েছে মুন্নি। এমনকী, তিন দিন ধরে তদন্ত চালিয়েও এই রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারল না কারা দফতর।
কারা দফতরের এডিজি অধীর শর্মার কাছে যে রিপোর্ট জমা পড়েছে, তাতে কার্যত বন্দি-পালানোর কিনারায় কোনও সূত্র দিতে পারেননি তদন্তের ভারপ্রাপ্ত কারাকর্তারা। তাতে শুধু পালানোর সম্ভাব্য উপায় হিসেবে বলা হয়েছে, হয় জেলের পাঁচিল টপকে কিংবা সরাসরি মেন গেট দিয়েই পালিয়ে গিয়েছে ওই মহিলা বন্দি। কিন্তু কোন পথে সে পালিয়েছে, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তদন্তকারীরা। যা নিয়ে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “জেলে তো পালানোর দু’টি পথই আছে। তদন্তে নতুন আর কী লেখা হয়েছে!” এডিজি নিজেও বলেন, ‘‘রিপোর্ট জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে স্পষ্ট নয়, কী ভাবে ওই বন্দি পালিয়েছে।”
গত ১৮ মার্চ বসিরহাটের ঘোজাডাঙা সীমান্তে মুন্নি ধরা পড়ার পরে কয়েক দিন সে দমদম জেলে ছিল। সেখান থেকে আলিপুর মহিলা জেলে পাঠানোর দু’দিন পরেই সে চম্পট দেয়। অথচ, এত দিন এ দেশে থাকার পরেও মুন্নির কোনও ছবি নেই কারা দফতরের কাছে। এখন মুন্নিকে কীসের ভিত্তিতে খোঁজা হবে, সেটা ভেবেই কুলকিনারা পাচ্ছেন না রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। স্বরাষ্ট্র দফতরের ওই কর্তার মতে, “খাগড়াগড় থেকে রানাঘাট— পরপর বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশিরা যুক্ত। তা সত্ত্বেও এখনও বেআইনি ভাবে এ দেশে ঢুকে আসা বাংলাদেশিদের ছবি তুলে রাখার ব্যবস্থা করেনি সরকার।” এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র দফতরের শীর্ষ কর্তারা জানাচ্ছেন, বন্দিদের ছবি তুলে রাখার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও নিয়মই নেই। তবে এক কর্তার কথায়, ‘‘এখন যা দিনকাল, তাতে আমাদের ছবি তুলে রাখার কথা ভাবতে হবে।’’
সমস্যা আরও বাড়িয়েছে জেলের ‘নিধিরাম সর্দার’ অবস্থা। সাধারণ ভাবে জেলগুলিতে বন্দিদের উপরে নজরদারির জন্য ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার সাহায্য নেওয়া হয়। জেলগুলির মেন গেট এবং নজরদারির টাওয়ারগুলিতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে। কিন্তু এডিজি-র কাছে জমা পড়া তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আলিপুর মহিলা জেলের মেন গেটে কোনও সিসি ক্যামেরাই নেই। ফলে, মুন্নির কোনও ছবি পাওয়া দূরে থাক, তার পালিয়ে যাওয়ার কোনও প্রত্যক্ষদর্শীও খুঁজে পাননি তদন্তকারীরা। কারা দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার জেলগুলিতে ঘটা করে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। এখন সেগুলির বেশির ভাগই কাজ করে না।’’ কেন এমন অবস্থায় পড়ে রয়েছে জেল? তার অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি কারাকতার্দের কাছে।
উপরন্তু, মুন্নি যে ওয়ার্ডে বন্দি ছিল, পালানোর সময়ে সেখানে নজরদারির দায়িত্বে থাকা মহিলা কারারক্ষী উপস্থিতই ছিলেনই না। তাঁর পায়ে ব্যথা থাকায় তিনি জেলেরই অফিসে গিয়ে বসে ছিলেন। বন্দিদের নজরে রাখার ভার দিয়ে এসেছিলেন এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে। রিপোর্ট পাওয়ার পরে ওই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন কারা দফতরের কর্তারা।
এই পরিস্থিতিতে কারাকর্তাদেরই একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, “এত তদন্তের পরেও যখন মুন্নি কী ভাবে পালাল তার হদিস মেলেনি, তখন কেন সিআইডি বা কলকাতা পুলিশকে ডাকা হচ্ছে না? ওই ধরনের তদন্তকারী দলে পুলিশ-কুকুর থাকে। তারা খুব সহজেই মুন্নি কোথা দিয়ে পালিয়েছে, তা অন্তত দেখিয়ে দিত।”
কারা দফতরের শীর্ষ কর্তারা অবশ্য জানান, আলাদা করে পুলিশকে জানানোর কোনও প্রয়োজন নেই। নিয়ম মেনে আলিপুর থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। পুলিশ চাইলে তদন্ত করতেই পারে।