ভিক্টোরিয়ার গাছে এমনই লাইকেনের খোঁজ পেেয়ছেন সুস্মিতা (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র
পুরনো গাছের গুঁড়িতে ব্যাঙের ছাতার মতো ছোপ-ছোপ দেখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ প্রথমে মনে করেছিলেন, হয়তো গাছের কোনও রোগ হয়েছে। সেই মতো ডাকা হয়েছিল তাঁকে। তিনি সুস্মিতা বসু—‘গাছের দিদিমণি’।
ভিক্টোরিয়ায় কোন ধরনের কী কী গাছ রয়েছে, তা কত বছরের পুরনো, তার সবই মুখস্থ ‘গাছের দিদিমণির’। অবশ্য শুধু ভিক্টোরিয়াতেই নয়, সারা শহরের অলিগলির সিংহভাগ গাছ তাঁর চেনা। তিনি এসে দেখে জানালেন, কোনও রোগ নয়, ওগুলো হল লাইকেন— শৈবাল ও ছত্রাকের সংমিশ্রণ। যেখানে শৈবাল বা ছত্রাককে আলাদা করে চেনা যায় না। এই লাইকেন সেখানেই জন্মায়, যেখানে অক্সিজেনের গুণমান তুলনামূলক ভাবে ভাল। অর্থাৎ লাইকেনের উপস্থিতি ‘ভাল’ অক্সিজেনের নির্দেশক। ‘প্রকৃতি সংসদ’-এর সদস্য সুস্মিতার কথায়, ‘‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশপাশে রাস্তা এবং যানবাহনের দূষণ থাকলেও মেমোরিয়ালের ভিতরে কয়েকটি জায়গায় মাইক্রো-ক্লাইমেট জ়োন তৈরি হয়েছে। যেখানে বাতাসের গুণমান খুবই ভাল। যে জন্য সেখানে লাইকেন জন্মেছে।’’
সুস্মিতার কাছ থেকে এই আশ্বাসের পরে নিশ্চিত হন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ। মেমোরিয়ালের কিউরেটর-সেক্রেটারি জয়ন্ত সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘পারিপার্শ্বিক দূষণ সত্ত্বেও ভিক্টোরিয়ার ভিতরের বাতাসের গুণমান ভাল। না হলে লাইকেন জন্মাত না। সুস্মিতার থেকে এটা জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হই।’’ প্রসঙ্গত, মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ যে তাদের বাগানের জীববৈচিত্র নিয়ে ট্যুর চালু করেছেন, তা-ও সুস্মিতারই মস্তিষ্কপ্রসূত। অথচ সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে তাঁর কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই। এ ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান পুরোটাই নিজস্ব আগ্রহ এবং গাছপালার প্রতি ভালবাসাকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ নিজেকে স্ব-শিক্ষিত করে তুলেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে গাছের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু, আর এখন শহরের কোথায় কী প্রজাতির গাছ রয়েছে, কোথায় আগে কতগুলি গাছ ছিল, এখন তার সংখ্যা ক’টায় এসে ঠেকেছে— সবই তাঁর নখদপর্ণে। অবশ্য নিজস্ব প্রচেষ্টার পাশাপাশি গাছ, বৃক্ষজাতীয়, বিশেষত ঘন পাতার গাছ চেনার ক্ষেত্রে অফুরন্ত সাহায্য পেয়েছেন ‘প্রকৃতি সংসদ’-এরই আরও দুই সদস্য নরেন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রকাশ রায়ের কাছ থেকে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গাছ-অডিটের কাজও সুস্মিতারই করা। লকডাউনের সময়ে তিনি বাগানের গাছেদের অডিট করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সুস্মিতার সম্পর্কের সূত্রপাতও আশ্চর্য ভাবে। ২০১৯ সালে ভিক্টোরিয়ায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে ‘প্রকৃতি সংসদ’-এর তরফে প্রয়াত পক্ষীবিদ কুশল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুস্মিতাও উপস্থিত ছিলেন। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরেই অন্যান্য জায়গার মতো ভিক্টোরিয়ার ভিতরের গাছগাছালির ছবি তুলেছিলেন তিনি। মেমোরিয়ালের জীববৈচিত্র নিয়ে বলার সময়ে সুস্মিতা সেই ছবিগুলি দিয়েই একটি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশন তৈরি করে দেখান, যা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ। তার পর থেকে ভিক্টোরিয়ার গাছগাছালির পরামর্শদাতা তিনি-ই।
ভিক্টোরিয়ার ভিতরে গাছগাছালির উপস্থিতির কারণে অনেক জায়গাতেই ‘থার্মাল হটস্পট’-এর পরিবর্তে ‘থার্মাল কোল্ডস্পট’ তৈরি হয়েছে। কারণ গাছেরা বাষ্পমোচন করে। যে কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকা তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা থাকে। এই কারণে শহরে আরও বেশি করে গাছ পোঁতা দরকার বলে জানাচ্ছেন সুস্মিতা।
অতীতে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর রিপোর্টে ধরা পড়েছিল, কী ভাবে যানবাহনের ধোঁয়া দূষণে ভিক্টোরিয়ার সাদা মার্বেল পাথর হলদেটে হয়ে যাচ্ছে। সেই রিপোর্টের পরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং সংলগ্ন চত্বরের দূষণ কমানোর জন্য কলকাতা হাই কোর্ট একাধিক রায় দিয়েছিল। যদিও পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘তার পরেও দূষণ হয়েই চলেছে। ২১ জুলাই কী হল, কী ভাবে নিয়ম ভেঙে বেআইনি পার্কিং হল— তা সবাই দেখেছেন।’’
তবু তার মধ্যেই যানবাহনের ধোঁয়াদীর্ণ শহরে ভিক্টোরিয়ার ভিতরে ‘ভাল’ অক্সিজেনের খোঁজ পেয়ে যারপরনাই আহ্লাদিত মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ এবং ‘গাছের দিদিমণি’!