স্মৃতি: বেথুন স্কুলের গ্রন্থাগারে রাখা বিদ্যাসাগরের মেহগনি কাঠের চেয়ার। নিজস্ব চিত্র
সাবেক কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে নতুন স্কুলবাড়ির পত্তন দেখে যেতে পারেননি জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুলবাড়ির কাজকর্ম দেখতে এগিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনিই স্কুলের প্রথম প্রেসিডেন্ট। বেথুন স্কুলের গ্রন্থাগারে আজও যত্নে রাখা বিদ্যাসাগরের বসার মেহগনি কাঠের চেয়ার।
ঠিক তেমনই রবীন্দ্রনাথের স্কুল ওরিয়েন্টাল সেমিনারি খুঁজে বার করেছে ১৮২১-এর ‘স্টোরিজ় ফ্রম শেক্সপিয়র’ বা উনিশ শতকীয় অ্যাটলাস, চসার রচনাসমগ্রের সঙ্কলন। অথবা ১৮৭২-এ প্রতিষ্ঠিত বৌবাজারের লরেটো ডে স্কুল খুঁজে বার করেছে সেই আদ্যিকালে স্কুলবাড়ির নির্মাতা মার্টিন বার্ন সংস্থার তৈরি নকশা।
ইতিহাস পড়ার পাশাপাশি স্কুলস্তরে হাতেকলমে ইতিহাস-চর্চা বা পরিপার্শ্ব ঘিরে থাকা অতীতের সুলুকসন্ধানে ইদানীং জোর দিচ্ছেন শিক্ষাবিদেরা। পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-পাঠ্যক্রমেও এই ভাবে পড়ুয়াদের ইতিহাস-সম্পর্কিত ‘প্রোজেক্ট’ তৈরির গুরুত্ব বাড়ছে। স্কুলশিক্ষায় নানা ধরনের উদ্ভাবনী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের একটি মঞ্চ ‘বিচিত্র পাঠশালা’ এ বার কলকাতার স্কুলগুলির ইতিহাস মেলে ধরতে ব্রতী। ‘ম্যাজিক অব মাই স্কুল’ বলে তাদের প্রকল্পে শামিল হয়ে নিজের স্কুলের ইতিহাসের গরিমায় উজ্জীবিত হচ্ছে পড়ুয়ারা। আহ্বায়কেরা জানাচ্ছেন, মোট ২৫টি স্কুল এই কাজটি করেছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি সরকারি স্কুলও রয়েছে।
শুধু সূদূর অতীত নয়, কলকাতার সমাজ-জীবনের সাম্প্রতিক ইতিহাসেরও ছোঁয়াচ মিশেছে স্কুলগুলির ইতিহাস-চর্চায়। যেমন বৌবাজারের লরেটোর ১০০ বছর বাদে দোলনা স্কুল তৈরির সময়কার নানা লেখাপত্র, বদলানো কলকাতার প্রেক্ষাপটে স্কুল-লাগোয়া ক্রেশ এবং কর্মরত মায়েদের সমস্যার কথা বলছে। আবার দোলনা স্কুলেও রয়েছে বেশ কয়েকটি ঢাউস সাবেক পিয়ানো। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জয়া মিত্র যেমন অরবিন্দ-স্মারক নানা সামগ্রী স্কুলে রেখেছিলেন। সে-সব নিয়ে অরবিন্দ স্মারক গ্যালারিও স্কুলে রয়েছে। স্কুলটির চরিত্রে এ সবই মাত্রা জুড়ছে। ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত জিইয়িশ গার্লস স্কুল আবার ধারাবাহিক ভাবে স্কুলের নানা
অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত সেই উনিশ শতকের রুপোর বাহারি কাপ, লাইব্রেরির প্রাচীন হিব্রু গ্রন্থ প্রদর্শনীতে সাজিয়েছে। আয়োজকেদের ডাকে লকডাউনের আগেই বেশির ভাগ স্কুল নিজেদের ইতিহাস নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। গত শিক্ষক দিবসে এই কাজটি নিয়ে একটি ওয়েবসাইট প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দুই খণ্ডে মলাটবন্দি কলকাতার স্কুলগুলির একটি ইতিহাস বইও প্রকাশিত।
প্রাক্তন আমলা তথা ইতিহাস-বিষয়ক প্রাবন্ধিক জহর সরকারের মতে, ‘‘এমন প্রকল্প পড়ুয়াদের ইতিহাসবোধ তৈরিতে সাহায্য করছে।’’ আহ্বায়কদের তরফে গণসংযোগ বিষয়ের শিক্ষিকা শুভা দাস মল্লিক বলেন, ‘‘স্কুলগুলি নিজের মতো করে ইতিহাস-চর্চা করেছে। শিক্ষক, পড়ুয়ারা সকলেই দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করেছেন। নিজের স্কুলে আগে কারা প়ড়তেন বা পড়াতেন, তখন সমাজ-জীবনে কী ঘটছিল তা জানলে পড়ুয়াদের আজকের সময় নিয়েও চোখ খুলবে। পরে ওয়েবসাইটগুলি আরও উন্নত করা হবে।’’