প্রতীকী ছবি।
ধীরে ধীরে কথা ফুটেছিল, শুনতেও পাচ্ছিল তিন বছরের শিশুটি। কিন্তু বছর ঘুরতেই সংক্রমণের ধাক্কায় সব ওলটপালট হয়ে যায়। খুলে ফেলতে হয় অন্তঃকর্ণে প্রতিস্থাপন করা ‘ককলিয়ার’ যন্ত্রটি। ফলে সেই আগের মতো কথা বলায় অসুবিধা, শুনতে না পাওয়ার সমস্যা ফিরে আসে বাসন্তীর শিবগঞ্জের বাসিন্দা দীপ দাস নামে শিশুটির জীবনে।
ছেলের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও বৃদ্ধি পাওয়ায় চিন্তায় পড়েছিলেন বাবা-মা। অন্য দিকে, এক বার সংক্রমণ হওয়ার জেরে আর অন্তঃকর্ণে যন্ত্র প্রতিস্থাপনেও রাজি ছিলেন না তাঁরা। কিন্তু দমেননি এসএসকেএমের নাক-কান-গলার চিকিৎসকেরা। বার বার তাঁরা দীপের বাবা-মাকে বোঝাতে শুরু করেন, সংক্রমণ সেরে গেলে মাথার অন্য দিকে আবার যন্ত্রটি প্রতিস্থাপন করে শিশুটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব। শেষে রাজি হয়ে যান দীপের বাবা-মা দীপঙ্কর ও গোলাপি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যন্ত্রটি পাওয়া নিয়ে। কারণ প্রথম বার যেহেতু কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে যন্ত্রটি মিলেছিল, দ্বিতীয় বারের অস্ত্রোপচারের জন্য সেটি আর পাওয়া যেত না। শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করার পরে মেলে যন্ত্রটি। সেটি প্রতিস্থাপন করার পরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে এখন সাত বছর বয়সি দীপ।
তবে প্রশ্ন উঠছে, বছরে যত জন রোগীর এই ধরনের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন, তাদের সকলেরই কি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছনো সম্ভব? সেটা হয় না বলেই রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রায় ১০০ জন জন্মগত ভাবে মূক ও বধির শিশু ‘ককলিয়ার’ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মাধ্যমে ওই যন্ত্র মিলবে আর কবে অস্ত্রোপচারের ডাক আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না স্বাস্থ্য শিবিরের কেউই। এসএসকেএমের ‘ইনস্টিটিউট অব ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি’ বিভাগের চিকিৎসক অরিন্দম দাস-সহ অন্যান্য চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে এই রকম শিশুদের অস্ত্রোপচার না করলে আজীবন তাদের মূক ও বধির হয়ে থাকার আশঙ্কাই বেশি। তাই তালিকাভুক্ত শিশুদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন।”
কিন্তু কেন করা যাচ্ছে না এই অস্ত্রোপচার? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ‘ককলিয়ার’ যন্ত্রটির দাম প্রায় ছয় থেকে সাড়ে ছ’লক্ষ টাকা। প্রতি বছর কেন্দ্রের অ্যাডিপ (এডিআইপি) প্রকল্পে সর্বাধিক ১৫টি যন্ত্র পায় রাজ্য। আর সেখানে প্রতি বছর এই অস্ত্রোপচারের জন্য তালিকাভুক্ত হচ্ছে অন্তত ১০০ জন শিশু। ‘ইনস্টিটিউট অব ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি’ বিভাগের শিক্ষক চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তের কথায়, “অনেক সময়ে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানালে যন্ত্রটি কেনার অনুদান মেলে। আমাদের এখানে বছরে অন্তত ৫০টি অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপনের পরিকাঠামো রয়েছে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান ও কেন্দ্রীয় প্রকল্প মিলিয়ে বছরে মেরেকেটে ২০টি অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়।”
স্বাস্থ্য শিবির সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপনে নিজস্ব প্রকল্প চালু করেছে প্রতিবেশী তিনটি রাজ্য। যেমন, কেরলে এই প্রকল্পের নাম ‘শ্রুতিতরঙ্গম’, অসমে ‘প্রতিধ্বনি’। আবার অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাস্থ্য প্রকল্প ‘আরোগ্যশ্রী’-র মাধ্যমে এই যন্ত্র পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। নাক-কান-গলার চিকিৎসকেরা বলছেন, “জন্মগত ভাবে মূক ও বধির শিশুদের এই চিকিৎসা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করাতে হয়। তাই রাজ্যের নিজস্ব প্রকল্প থাকলে প্রতি বছর অনেক বেশি সংখ্যক শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।” ২০১৭-য় প্রথম অস্ত্রোপচার হয়েছিল দীপের। তার পরে আবার ২০২১-এ। তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আগে গোলাপি বললেন, “আমার দীপের মতো সকলেই যেন শুনতে ও বলতে পারে।”