—প্রতীকী চিত্র।
প্রভাবশালীর প্রভাবই কি কাজ করল গণপিটুনি-কাণ্ডে?
বারাসতের কাজিপাড়ায় একটি বালকের খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তার সমাজে প্রভাবশালী। তার এক ডাকে বহু মানুষ চলে আসতেন। তদন্তে জানা গিয়েছে, বালকের খুনের ঘটনায় গ্রেফতারি এড়াতে সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজের অনুগামীদের দ্বারা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করিয়েছিল যে এলাকায় একটি দল শিশু চুরি করছে। এমনকি এ-ও জানা যায়, দেহ উদ্ধারের পরে কিডনি ও চোখ উপড়ে নেওয়ার গুজব রটিয়ে পোস্ট করা হয়েছিল মূল অভিযুক্তের নির্দেশেই। যা ঝড়ের বেগে ভাইরাল হয় বারাসত-সহ উত্তর ২৪ পরগনায়। তার জেরে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার বনগাঁর গোপালনগরে। যার মোকাবিলায় আপাতত হিমশিম খাচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ প্রশাসন।
এ দিন বনগাঁর গোপালনগর থানার অধীন মামুদপুরে রাস্তার ধারে বসেছিলেন এক ভবঘুরে। কয়েক জন তাঁকে দেখে পরিচয় জানতে চান। জবাব মনের মতো না পেয়ে ভবঘুরেকে চড়-থাপ্পড় মারা শুরু হয়। তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওই ভবঘুরেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় গোপালনগর থানার পুলিশ।
বারাসতের কাজিপাড়ার বাসিন্দা, এগারো বছরের বালক ফারদিন নবীর খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত, তার জেঠু আনজের নবীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ফারদিনকে ছেলেধরা তুলে নিয়ে গিয়েছে, তার কিডনি ও চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে, এমন গুজব রটানো পোস্ট আনজের তার অনুগামীদের দিয়েই করিয়েছিল বলে পুলিশ রবিবার জানিয়েছিল।
এ দিন কাজিপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, আনজের তার পেশার কারণে সমাজে ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। তার বক্তব্যে প্রভাবিত হতেন মানুষ। দেহ উদ্ধারের দিন তাই আনজের যখন রটিয়ে দেয় যে তার ভাইপোর কিডনি ও চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকা। আনজেরের অনুগামীরাই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল বলে এ দিন কাজিপাড়ার লোকজনই জানিয়েছেন। সেখানকার বাসিন্দা তথা একটি কবরস্থান কমিটির অন্যতম সদস্য কাশেম হাওলাদার বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি ও তার পরিবারকে সমাজে মানা হত। তাই কিছু লোক সত্যি জানার আগেই ওর কথায় গুরুত্ব দিয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন। দু’-একটি গ্রুপ থেকে সেগুলি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। এলাকার বদনাম হচ্ছে এতে।’’
যার পরিণতিতে বারাসত ছাড়িয়ে ব্যারাকপুর, অশোকনগর, দেগঙ্গা, বনগাঁ, গোপালনগরের মতো জায়গায় একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া অবশ্য বলেন, ‘‘এই ধরনের সমস্যা মিটতে একটু সময় লাগে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ লিফলেট বিলি, স্কুলের সামনে ও সমাজমাধ্যমে প্রচার-সহ নানা ধরনের পদক্ষেপ করছে।’’
কাজিপাড়ার বাসিন্দা কিংবা পুলিশ— সকলেই মনে করছেন, যে ভাবে উস্কানিমূলক পোস্ট সহজে ভাইরাল হয়, এ ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে। ফারদিনের খুনের ঘটনার পুনর্নির্মাণ করাতে সোমবার আনজেরকে কাজিপাড়ায় নিয়ে যায় পুলিশ। তার মতো প্রভাবশালী যে এ ভাবে অনুগামী তথা এলাকার মানুষকে ভুলপথে চালিত করবে, তা এখনও মানতে পারছেন না কাজিপাড়ার অনেকে। সেই ভুলের খেসারত নিরীহ ও অসহায়দের দিতে হচ্ছে দেখে লজ্জিত এখন অনেকেই।
গত বুধবার বারাসতের কামাখ্যা মন্দির এলাকায় এক মহিলা খাবারের হোটেল খুঁজতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন। সেই দিনই সরোজ পার্কে কলচুরির অভিযোগে হাতেনাতে ধরা পড়া এক যুবককেও ছেলেধরা অপবাদে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ দিন ওই সব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, অন্য রাজ্যের শিশুচুরির পোস্টও বারাসত তল্লাটের বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বারাসতের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্পর্শ নীলাঙ্গী এ দিন জানান, বালকটির দেহ উদ্ধারের দিনে কাজিপাড়ায় আইনশৃঙ্খলার যে সমস্যা তৈরি হয়, তাতে বাইরের অনেক লোক ছিল। যারা চোখ ও কিডনি কাটার গুজব বিশ্বাস করে নিজেদের জায়গায় ফিরে গিয়েছে। পুলিশ মনে করছে, বাচ্চাদের নিয়ে মানুষের মনে ভয় কাজ করছে। তার থেকেই গণপিটুনি দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
এ দিন কামাখ্যা মন্দির এলাকার এক দোকানদার বলেন, ‘‘আগে কখনও এখানে এমন ঘটেনি। সত্যিই ভয়ের কিছু রয়েছে, না কি সবটাই সাজানো, বুঝতে পারছি না। সে দিন যে ভাবে ওই মহিলাকে মারা হল, আমরা দেখে শিউরে উঠেছি। কত বাইরের লোক জড়ো হয়ে গেল! আশা করছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’’
উল্লেখ্য, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং) বিল, ২০১৯ সালের অগস্টেই এ রাজ্যে পাশ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে অভিযুক্তদের ওই আইনে মৃত্যুদণ্ড যাতে দেওয়া যায়। যদিও সেই আইন এখনও প্রণয়ন হয়নি।
(চলবে)