বিবেকানন্দ রোড

সবই এখন কেমন ছাড়া-ছাড়া

আমি আসলে জন্ম অনিকেত। বাবা মারা যান আমার ছ’মাস বয়সে। মা যখন চলে যান তখন আমার বয়স দশ। তার পরে কলকাতা শহরে কত যে বাড়িতে ঘুরেছি ভাড়াটে হিসাবে ঠিক নেই। তাই পাড়া ঠিক সে ভাবে তৈরি হয়নি। তবুও যদি পাড়া বলা যায়, তা হলে বলব বরং আমার ঘরে ফেরা ১১৯ বিবেকানন্দ রোডের ঠিকানায়।

Advertisement

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪৩
Share:

আমি আসলে জন্ম অনিকেত। বাবা মারা যান আমার ছ’মাস বয়সে। মা যখন চলে যান তখন আমার বয়স দশ। তার পরে কলকাতা শহরে কত যে বাড়িতে ঘুরেছি ভাড়াটে হিসাবে ঠিক নেই। তাই পাড়া ঠিক সে ভাবে তৈরি হয়নি। তবুও যদি পাড়া বলা যায়, তা হলে বলব বরং আমার ঘরে ফেরা ১১৯ বিবেকানন্দ রোডের ঠিকানায়।

Advertisement

১৯৭৯ সাল থেকে এখানে থাকছি। জায়গাটা বেশ নির্ঝঞ্ধাট। তবে একটা সময় সত্তরের দশক নাগাদ এখানে প্রচুর রাজনৈতিক গোলমাল দেখেছি। তখন মাঝেমধ্যে দুমদাম দু’একটা বোমাও পড়ত। তার পরে ধীরে ধীরে এলাকাটা শান্ত হয়ে গেল। পাড়া তৈরি হয় তার বাসিন্দাদের নিয়ে। যে মানুষগুলো এই এলাকায় বাড়ি বানিয়েছিলেন, একটা সময়ের পরে তাঁদের উত্তরসূরিরা তিন চার পুরুষের সেই ভিটে বিক্রি করে শহরের প্রান্তীয় এলাকায় যেতে শুরু করেন। আর এই পুরনো জায়গাগুলোর শিকড় আলগা হতে শুরু করে।

বিবেকানন্দ রোডের মতো উত্তর কলকাতার পুরনো এলাকাগুলো খানিকটা অতিরিক্ত রাজনীতিকরণেরও ভুক্তভোগী। এখন যাঁরা পুরনো বাড়িগুলো কিনে নিয়ে থাকেন বা ভেঙে ফ্ল্যাট বানান তাঁদের কাছে এই জায়গা কতটাই বা ‘পাড়া’?

Advertisement

পুরনো পাড়াগুলোর আগে নামডাক ছিল হাঁড়ির খবর নেওয়ার বিষয়ে। পাশের বাড়ির মানুষটার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ার বদ অভ্যেস যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিপদে ডাক না পেলেও ঝাঁপিয়ে পড়ার রেওয়াজ। আগে দেখতাম যাঁদের গাড়ি আছে, তারা অনেকটা দূরে গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পা মিলিয়ে স্কুলে আসত। এখন স্কুলের দরজার সামনে গাড়ি থেকে নেমে, গাড়িবিহীন বন্ধুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়াটাই বোধহয় সংস্কৃতি। পৃথকীকরণের এই পদ্ধতিগুলোর হাত ধরে বদলে যাচ্ছে পাড়া-সংস্কৃতিও।

আমাদের যুবক বয়সে রকে আড্ডা একটা বিরাট আনন্দের বিষয় ছিল। ইদানীং ‘রক-কালচার’ প্রায় উঠেই গিয়েছে। কখনও সেখানে দোকান গজিয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার রক ঘিরে দিচ্ছেন লোহার গ্রিলে। আগে রকের অনেক ভাগিদার থাকত। এক বার মনে পড়ে এক বন্ধুর বাড়ির রকে বসে আড্ডা দিচ্ছি আর মুগ্ধচোখে পথে চলা সুন্দরী মেয়েদের দেখছি। কিছুক্ষণ পরে বন্ধুর বাবা এসে আমাদের তুলে দিলেন। কারণ, তাঁদের আড্ডার সময় হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য বুঝেছি রক দখলের জন্য তাঁদের উদ্দেশ্যও আমাদের থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না।

আমরা কিন্তু তখন গুরুজন দেখলেই পালিয়ে যেতাম। ছোটবেলায় মনে আছে দেরি করে বাড়ি ঢোকার জন্য পাশের বাড়ির জ্যাঠা বকুনি দিতেন। কিন্তু কিচ্ছুটি বলার জো ছিল না। আজকাল দেখি রাস্তার মোড়ে বাইক নিয়ে কয়েক জনের জটলা থেকে হঠাৎ একটা আপত্তিকর মন্তব্য ভেসে আসে। পরিচিত কেউ থাকলে রুখে দাঁড়ানোর বদলে, চোখ নামিয়ে চলে যান। এর একটা কারণ বোধহয় পাড়াতুতো-গার্জেনশিপ ধারণাটাই অচল হয়ে যাওয়া। এটা উঠে গিয়ে ভাল হয়েছে, না মন্দ বলতে পারি না। তবে পাড়ার ধারণাটারই একটা শ্রী পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।

একটা ঘটনা মনে পড়ছে, আমার বাড়ির পিছনের দিকে পুজোর সময় খুব জোরে মাইক বাজছিল। অনেক বার ভেবেছি, গিয়ে বলি একটু আস্তে বাজাতে। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। ভয় পেয়েছি চিনবে কি না? পাড়ার ছেলে বলে আগে যাঁদের চিনতাম, যাঁদের সামনে গিয়ে জোর খাটিয়ে বলা যেত মাইকটা আস্তে করে দিন ভাই, সেই ছেলেদেরই এখন খুঁজে পাই না। বিজয়া সম্মিলনী, পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চোখে পড়ে না। তার একটা বড় কারণ হয়তো মানুষের ব্যস্ততা। পাড়ায় দায়িত্ব নেওয়ার সময়টা যখন আসছে তখন হয়তো কর্পোরেট হাউসের বেশি মাইনের চাকরি শুষে নিচ্ছে তাঁর দিনরাত। সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ার মোড়ের সম্পর্কগুলোও।

শুধু জীবনযাত্রাই নয়, বদলে গিয়েছে সংস্কৃতি যাপনও। স্বাভাবিক ভাবে পাড়ার পুজোটাও আন্তরিক থেকে কর্পোরেট হয়ে গিয়েছে। পুজো মানে এখন পাখির চোখ প্রাইজ পাওয়া। আগে পুজো মানে সকলের সঙ্গে দেখা হওয়া, পরস্পরের খোঁজ বিনিময়ের মাধ্যমে একটা সত্যিকারের পুনর্মিলন উৎসব। সেই কাঠামোটা একদম ভেঙে গিয়েছে। আসলে গোটা উত্তর কলকাতারই মুখটা বদলে গিয়েছে।

এই অঞ্চলের মানুষের একটা সমস্যা হল, তাঁরা নিজেদের ঘড়িতে চলেন। সমাজের যে একটা ঘড়ি আছে, সেটা বেশির ভাগ সময়ে কারও খেয়াল থাকে না। অনেক বাড়িতেই দেখি, পুরসভার লোক ময়লা নিয়ে চলে যাওয়ার পরে, ফের কাজের লোকের হাত দিয়ে প্লাস্টিক ভর্তি ময়লা ফেলতে পাঠিয়ে দেন। নিযুক্ত ব্যক্তিটিও আবার ঠিক আশপাশের গোটা সাতেক বাড়ি পেরিয়ে, একটি বাড়ির সামনে প্যাকেটটি বসিয়ে রেখে আলতো করে চলে যান। তবে পুরসভা এলাকায় ভাল কাজ করার চেষ্টা করে। সকাল চারটে থেকে ঝাড়ুদারদের ঝাঁটার আওয়াজ কানে আসে।

কাছেই শ্রীমানি বাজার আর মানিকতলা বাজার। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মাঝেমধ্যে ব্যাগ হাতে পৌঁছে যাই শ্রীমানি বাজারে। স্বভাবগত ভাবেই আমি মানুষের সঙ্গে ভাব করি। তাই অনেক দিন পরে, বাজারে গেলেও দেখি মানুষজন মনে রেখেছে। ভাল লাগে। গাছপালাও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। পুরসভা ছোট ছোট করে জায়গা ঘিরে গাছ লাগাচ্ছে। জল জমার সমস্যাও আগের তুলনায় বেশ কমেছে। কখনও জমলেও খুব তাড়াতাড়ি তা নেমে যায়। কাজের প্রয়োজনে অনেক সময়েই বেশি রাতে ফিরতে হলেও, নিরাপত্তার অভাব বোধ করিনি কোনও দিনও। রাস্তায় যথেষ্ট আলো থাকে। দু’একটা ছিঁচকে চোরের উপদ্রব ছাড়া তেমন কোনও বড় ঘটনা এখন পর্যন্ত কানে আসেনি।

এই অঞ্চলে রাস্তাঘাটও চিরকালই বেশ চওড়া। ফুটপাথও রয়েছে। বাড়িগুলোর পাশাপাশি ফুটপাথে দেখি, অনেক মানুষ সমান্তরাল সংসার পেতে থাকেন। তবে বড় শহর মানে মানুষ আশ্রয় নিতে আসবেনই। অনেকে হাঁটতে অসুবিধা হয় বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু উত্তর কলকাতায় এমনিতেই লোকের ভিড়ে থাকার জায়গা কম। সেখানে এই দরিদ্র মানুষগুলো কোথায়ই বা যাবেন? তবে বস্তিগুলো আগের তুলনায় অনেক সুগঠিত হয়েছে। কোনওমতে বাঁচা নয়, তাঁদের মধ্যেও দেখি সচেতনতা বাড়ছে ধীরে ধীরে। এই এলাকায় এখনও মধ্যবিত্ত বাঙালির সংখ্যাই বেশি। তবে ক্রমাগত ‘বড়বাজার’ এখানে ঢুকে পড়ছে। বাড়ছে অবাঙালিদের সংখ্যা।

নতুনদের মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের তো বয়স হয়ে গিয়েছে, এমনিতেই সন্তর্পণে বাঁচি। চোখ মেলাতে ভয় হয়, এখনই যদি বাতিল বলে অবহেলা সইতে হয়। তোমরা যদি একটু এগিয়ে আসো, একটু হাল ধরো সম্পর্কগুলোর, তা হলে বোধহয় পাড়াটা আবার সকলের হয়ে ওঠে।

লেখক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement