n মর্মান্তিক: গুদাম থেকে বার করে আনা হচ্ছে মৃতদের দেহ। শনিবার, বিলকান্দায়। নিজস্ব চিত্র
মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় চার জন সম্ভবত প্রাণপণে ছুটেছিলেন তেতলার ছাদের দিকে। ছাদের দরজায় ঝুলছিল তালা। কিন্তু চাবি ছিল না তাঁদের কাছে। কারখানার ভিতরে আটকে পড়ায় বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আর আগুনে ঝলসে কার্যত দলা পাকিয়ে গিয়েছিল চারটি শরীর।
বিলকান্দার তালবান্দা শিল্পতালুকে জ্বলন্ত গুদামের ভিতর থেকে শনিবার এই অবস্থাতেই উদ্ধার হল চার কর্মীর দেহ। এ দিন বেলার দিকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা গুদামের তেতলার সিঁড়ির চাতাল থেকে তন্ময় ঘোষ, স্বরূপ ঘোষ, সুব্রত ঘোষ এবং অমিত সেন নামে ওই চার কর্মীর দেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের আত্মীয়দের গুদামের তেতলায় নিয়ে গিয়ে দেহ শনাক্ত করানো হয়। ২০১০ সালে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের সময়ে কয়েক জন ছাদে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। সে ক্ষেত্রেও ছাদের দরজা তালাবন্ধ ছিল। চাবি না থাকায় কেউই বেরোতে পারেননি। সিঁড়ির সামনেই উদ্ধার হয়েছিল তাঁদের দেহ।
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, কারখানার একতলায় জেনারেটর কিংবা অন্য কোনও যন্ত্রের ঘরে প্রথমে আগুন লেগেছিল। বুধবার মাঝরাতে যখন আগুন লাগে, তখন ওই কর্মীরা ঘুমোচ্ছিলেন বলেই মনে করছে পুলিশ। তদন্তকারীদের ধারণা, গুদামের একতলায় আগুন বড় আকার ধারণ করার পরে ঘুম ভাঙে ওই চার জনের। তার পরে তাঁরা তেতলার ছাদে উঠে প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছাদের দরজায় তালা দেওয়া থাকায় সেই সুযোগ তাঁরা পাননি।
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘ফরেন্সিক তদন্ত হবে। চারটি দেহই পুড়ে গিয়েছিল। পুলিশ কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।’’ বুধবার মাঝরাতে আগুন লাগার পরে দু’দিন ধরে দমকলকর্মীরা গুদামের ভিতরে পৌঁছতেই পারেননি। বাইরে থেকেই তাঁরা আগুনে জল দিয়েছেন। আগুনে জল দেওয়ার জন্য পে লোডার দিয়ে গুদামের বিভিন্ন দেওয়াল ভাঙা হয়েছিল। শুক্রবার রাতেও গুদামের একতলার সামনের দিকের একটি দেওয়াল আগুনে জল দেওয়ার জন্য ভাঙা হয়। এ দিনও কোনও কোনও জায়গায় আগুন দেখা গিয়েছে।
শনিবার পরিস্থিতি খানিকটা আয়ত্তে আসায় দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর লোকজন গুদামের ভিতরে ঢুকে ওই চার কর্মীর খোঁজে তল্লাশি শুরু করেন। ওড়ানো হয় ড্রোনও। দোতলা ও তেতলার সিঁড়ির মাঝের জায়গায় চারটি দেহ একসঙ্গে পড়ে থাকতে দেখা যায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। দু’টি মোবাইলও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়। যেগুলি মৃতদের বলেই মনে করা হচ্ছে।
মৃত অমিত সেনের মামা ঝন্টু হালদার জানান, হাতের বালা, সঙ্গে থাকা গাড়ির চাবির মতো জিনিসপত্র দেখেই মৃতদের দেহগুলি শনাক্ত করা হয়েছে। ঝন্টু বলেন, ‘‘অমিতের মাথার চুল পুড়ে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে মোটরবাইকের চাবি ছিল। সে সব দেখেই আমি শনাক্ত করি। চার জন একই জায়গায় উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। দেখে আমার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। প্রাণে বাঁচতে সবাই মিলে ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ছাদের দরজা তালাবন্ধ ছিল। কী ভয়াবহ কষ্ট পেয়েছে ওরা!’’
চার জন যে আর বেঁচে নেই, শুক্রবারই সে আশঙ্কা করেছিলেন তাঁদের পরিজনেরা। তবুও অত্যাশ্চর্য কিছু হতে পারে, এমন আশা করেই তাঁরা প্রতিদিন কারখানার সামনে এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন। এ দিন চার জনের দেহ গুদামের তেতলায় পড়ে থাকার খবর আসতেই গুদামের অদূরে বসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সুব্রত ঘোষের জেঠামশাই শ্যামাপদ ঘোষ। একটু দূরে বসেছিলেন সুব্রতের বাবা রামপদবাবুও। কাঁদতে কাঁদতে শ্যামাপদবাবু বলেন, ‘‘এই দেহ দেখার জন্যই কি বসেছিলাম! ভেবেছিলাম হয়তো সুব্রত পালিয়েছে। ভয়ে আসছে না। কী মুখ নিয়ে ওর মায়ের কাছে ফিরব আমরা।’’
চারটি দেহের ময়না-তদন্ত এ দিনই হয়েছে। দুপুরের পরে ব্যারাকপুরে ২ নম্বর ব্লকের বিডিও অফিসে মৃতদের পরিবারের সদস্যদের হাতে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেন সাংসদ সৌগত রায়।