আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপই নির্দেশ দিয়েছিলেন সংস্কারের। ছবি: সংগৃহীত।
আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলায় সংস্কারের কাজ নিয়ে বিতর্ক হয় প্রচুর। ওই সংস্কার কাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষই। মহিলা চিকিৎসকের মৃত্যুর ঠিক পরের দিনই দেওয়া হয়েছিল ওই নির্দেশ। দাবি করা হচ্ছে, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন রেসিডেন্ট ডাক্তারেরা।
জরুরি বিভাগের চারতলার সেমিনার হলে ৯ অগস্ট মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। এর পর ১২ অগস্ট সেই চতুর্থ তলেই সংস্কারের কাজ চলছিল। ওই সংস্কারের জন্য আরজি কর কর্তৃপক্ষের ওয়ার্ক অর্ডারের একটি প্রতিলিপি এসেছে আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে (যদিও ওই চিঠির সত্যাসত্য নিয়ে সরকারের তরফে কিছু জানানো হয়নি এখনও)। আরজি করে কর্তব্যরত পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারকে ওই চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ। তারিখ, ১০ অগস্ট। অর্থাৎ, নির্যাতিতার মৃত্যুর ঠিক পরের দিন। জরুরি ভিত্তিতে আরজি করের বিভিন্ন বিভাগে ডক্টরস’ রুম এবং লাগোয়া শৌচালয় মেরামত ও সংস্কারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
তৎকালীন অধ্যক্ষ ওই চিঠিতে লিখেছেন, “আরজি করের বিভিন্ন বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জন্য ডক্টরস’ রুম এবং তার সংলগ্ন পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক শৌচালয়ের অভাব রয়েছে। রেসিডেন্ট ডাক্তারদের দাবি মতো তাই আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব এবং মেডিক্যাল এডুকেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে।”
সূত্রের খবর, আরজি করের মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে হাসপাতালের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অন্য চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন। সূত্রের দাবি, ওই বৈঠকেই উঠে এসেছিল ডক্টরস’ রুম এবং সংলগ্ন শৌচালয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য রেসিডেন্ট ডাক্তারদের দাবি।
বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা, তার খসড়াপত্র। ছবি: সংগৃহীত।
কী কী সংস্কার এবং মেরামতের প্রয়োজন, সে বিষয়ে একটি খসড়াও তৈরি হয়েছিল ওই বৈঠকে। বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার একটি খসড়া এসেছে আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে। (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আরএমও এবং এমও-র ঘরকে নার্সদের ‘চেঞ্জ রুম’ হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এর জন্য কাছে যে শৌচালয় রয়েছে, সেটি পরিবর্তন করতে হবে। ‘পিপিটি রুম’ ও নার্সদের জন্য আগে থেকে থাকা ‘চেঞ্জ রুম’-কে চার শয্যা বিশিষ্ট ডক্টরস’ রুম হিসাবে ব্যবহার করা হবে। সেখানে সংলগ্ন শৌচালয় থাকবে এবং এসি বসানো হবে। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য শৌচালয়ে সংস্কারের কাজের কথাও উল্লেখ রয়েছে খসড়ায়। পাশাপাশি ব্রঙ্কোস্কোপি রুমেও অল্পবিস্তর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং মনোরোগ বিভাগের শৌচালয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের কথাও লেখা রয়েছে।
আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপের নির্দেশেই যে সংস্কারের কাজ চলছিল, সে কথা বিভিন্ন সূত্র মারফত আগে থেকেই উঠে এসেছিল। যে চতুর্থ তলের সেমিনার নিয়ে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ উঠে এসেছিল, সেই চতুর্থ তলেই সংস্কারের কাজ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে ওই সংস্কারের কাজ যেখানে চলছিল, তা সেমিনার হলের অদূরেই। যে কারণে প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠতে শুরু করেছিল। কেন তড়িঘড়ি সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে।
হাসপাতালের ফুসফুস ও বক্ষরোগ বিভাগের তৎকালীন প্রধান অরুণাভ দত্ত চৌধুরী অবশ্য এই সংস্কার বিতর্কে জানিয়েছিলেন, তিনি ঘর ভাঙার কোনও অনুমতি দেননি। আচমকা ঘর ভাঙার শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সেমিনার হলের কাছের একটি ঘর সংস্কারের কথা হয়েছিল। কিন্তু কবে থেকে কাজ হবে, কী ভাবে কাজ হবে, সেই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ আমার কাছে আসেনি।”
তবে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে যে পড়ুয়া চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল, সে কথাও তখন জানিয়েছিলেন অরুণাভ। তাঁর বক্তব্য ছিল, “যে কর্মীরা হাসপাতালে সর্ব ক্ষণ থাকেন, তাঁদের ঘরে কী সংস্কার দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করতে আমি ছাত্রদের ডেকেছিলাম। তাঁদের সামনেই সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
এই চিঠি প্রকাশ্যে আসার পর বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “এত দিন তৃণমূলের লোকেরা বলছিল যে ৯ তারিখের আগে পূর্ত দফতরকে সংস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আজ তো বেরিয়ে গেল, ১০ তারিখে দিয়েছিল। ওই কারণেই তো বিরোধী দলনেতা হিসাবে আমি (‘অপরাজিতা’ বিলে) বলেছিলাম, ধর্ষকদের ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত। কিন্তু ধর্ষণের প্রমাণ লোপাটকারীদের কী ব্যবস্থা হবে? এই সংশোধনীই তো আমি চেয়েছিলাম, তাই মানেনি।”
তৃণমূল মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য পাল্টা বলেন, “এই নির্দেশ কেন জারি হয়েছিল, সে বিষয়ে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষই উত্তর দিতে পারবেন। তিনি তো সিবিআইয়ের তদন্তের অধীনেই রয়েছেন। সিবিআইয়ের তো অবশ্যই উচিত তাঁকে এ বিষয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। যদিও প্রাথমিক ভাবে এই চিঠিটি দেখে আমাদের মনে হয়েছে, এখানে সব বিভাগের সব শৌচালয়গুলির জন্যই বলা হয়েছে। কোনও নির্দিষ্ট একটি তল, বা কোনও নির্দিষ্ট একটি বিভাগের কথা এখানে উল্লেখ নেই। হাসপাতালের মেরামতি ও সংস্কারের জন্য যেমন সার্বিক চিঠি পূর্ত দফতরের কাছে যায়, এটি সেরকমই একটি চিঠি।”
একই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল, অবিলম্বে সিবিআইয়ের উচিত বিষয়টি নজরে আনা। আমি নিশ্চিত সিবিআই তদন্তের খাতিরে নজরে এনেছে এবং সুপ্রিম কোর্টে পেশ করবে। সে দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে থাকব। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী যা করছেন, সেটি নির্লজ্জ রাজনীতি। এর জবাব রাজনীতি দিয়েই দেওয়া উচিত। কিন্তু এই সময়ে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমরা বিচার চাইছি। আমরা চাই সিবিআই সত্যিই দ্রুত তদন্ত শেষ করুক, যাতে নির্যাতিতার পরিবার প্রকৃত বিচার পায়।”