বিশৃঙ্খল: পুরভোটের জন্য মনোনয়ন জমা দিতে আসা নেতা-নেত্রীর সমর্থকদের বিধি-ভাঙা ভিড়। সল্টলেকে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
ডেল্টা এবং ওমিক্রন সংক্রমণের লেখচিত্র যখন ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক তখনই সল্টলেকে মহকুমাশাসকের দফতরের কাছে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো জমায়েত করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সোমবারের ওই ঘটনায় অভিযোগের তির মূলত শাসকদল তৃণমূলের নেতাদের দিকে। যা নিয়ে বিধাননগরের বাসিন্দাদের অনেকেই সরব। কেউ কেউ নিন্দা করেছেন প্রকাশ্যেই। কেউ বা আড়ালে। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, ‘‘দাদাদের প্রভাব ভাইরাসের চেয়েও বেশি। না-হলে এমন ঝুঁকি নিয়ে কেউ ওই ভিড়ে শামিল হবেন কেন?’’
মনোনয়নের জমায়েত ঘিরে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন বিধাননগর পুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারাও। এফডি ব্লকের বাসিন্দা, আশি পেরোনো রামকৃষ্ণ ঘোষের কথায়, ‘‘এটাই তো এখন নিয়ম। কেন্দ্রীয় সরকারই হোক বা রাজ্য সরকার— শাসকদলের কাজকর্ম হামেশাই মানুষের মঙ্গলের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সময়ে এই ধরনের জমায়েত যাঁরা করলেন, তাঁরা কি ভুলে গিয়েছিলেন যে, এতে সাধারণ মানুষ তো বটেই, তাঁদের দলীয় কর্মীরাও সপরিবার আক্রান্ত হতে পারেন? আমরা বয়স্ক মানুষ, আমাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আরও বেশি।’’
সে দিনের ওই জমায়েত দেখে আঁতকে উঠেছিলেন বিদ্যুৎ ভবনে কর্মরত অনেকেই। ওই ভবনের পিছনেই মহকুমাশাসকের দফতর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মীর কথায়, ‘‘যাঁরা জমায়েত করেছিলেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাঁরা সকলেই কোনও না কোনও সুবিধা ভোগ করছেন। কেউ সিভিক ভলান্টিয়ার, কেউ হয়তো অটো চালান, কেউ বা সিন্ডিকেট। মিছিলে যোগ না দিলে তাঁরা সমস্যায় পড়তেন। ওঁরা জানেন, দাদার প্রভাব ভাইরাসের চেয়ে বেশি।’’
এডি ব্লকের বাসিন্দা, পেশায় অধ্যাপিকা দেবযানী ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, ‘‘কোভিডের সময়ে এই ধরনের জমায়েত কেন করা হবে? দিনকয়েক আগে আমাদের পাড়াতেই এক প্রার্থীকে দেখলাম, দলবল জুটিয়ে ভিড় তৈরি করে প্রচার করছেন। আমার বিষয়টি ভাল লাগেনি। জনপ্রতিনিধিরাই যদি সতর্ক না হন, সাধারণ মানুষকে তা হলে সচেতন করবেন কারা?’’ এফই ব্লকের বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘যাঁরা এটা করছেন, তাঁরা নিজেরাও তো আক্রান্ত হতে পারেন। শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, জলসাতেও প্রচুর জমায়েত হচ্ছে। এই সময়ে সরকার নির্দেশিত কোভিড-বিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত সকলের।’’
সোমবারের ওই জমায়েতের দায় অবশ্য কোনও নেতাই সরাসরি নিজের ঘাড়ে নিতে চাননি। বরং সেই দায় কর্মী-সমর্থকদের উপরে চাপিয়েছেন তাঁরা। প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দেওয়াতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কর্মী-সমর্থকদের আবেগের সঙ্গে জড়িত বলেই দাবি করেছেন বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু, বিধাননগরের যুব তৃণমূল সভাপতি জয়দেব নস্কর, চার নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ডাম্পি মণ্ডলের মতো অনেক নেতাই। ডাম্পির দাবি, ‘‘আমি কাউকে যেতে বলিনি। কিন্তু লোকজন সঙ্গে গেলে কি তাড়িয়ে দেব? সোমবার থেকে সরকার যা নির্দেশিকা দিয়েছে, সেই মেনে প্রচার করছি।’’
চিকিৎসকদের একাংশের আশঙ্কা, ওই ভিড়ের মধ্যে যে ক’জন উপসর্গহীন করোনা রোগী ছিলেন, তাঁদের থেকে সংক্রমণ ছড়াতে বাধ্য। টিভিতে দেখা গিয়েছে, ভিড়ের মধ্যে অনেকেই মাস্কহীন। এই ঘটনার পরে মানুষ কি ভোট দিতে যেতে সাহস পাবেন? বাগুইআটির বাসিন্দা, ষাটোর্ধ্ব সুখেন ঘোষের কথায়, ‘‘আমাদের মতো প্রবীণ নাগরিকদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কিন্তু আমি ভোট না দিলে আমার ভোট পড়ে যাবে। সেটাও তো মেনে নেওয়া যায় না।’’
অন্য দিকে, সরকারি আধিকারিক তথা এফডি ব্লকের বাসিন্দা প্রেমজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘বাড়িতে আমার বৃদ্ধা মা রয়েছেন। অনেক পরিবারেই প্রবীণ সদস্যেরা রয়েছেন। তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থ রাজনৈতিক দলগুলি না দেখলে মানুষ কেন ভোট দেবেন তাদের?’’