ছাতা হারাইবেন... কলকাতার রাস্তায় এক কালে শোনা যেত এই ফেরিওয়ালার ডাক। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে কোনও অন্তঃপুরবাসিনী সুরসিকা সেই ডাক শুনে মুচকি হেসে বলতেন, এদের জ্বালায় দেখছি সারা কলকাতার লোক ছাতা হারাবে! ফরিদপুরি ছাতা-সারাইওয়ালাদের লব্জে ‘স’ হয়ে যেত ‘হ’, তাই আদতে যে ছাতা ‘হারানো’ নয়, ‘সারানো’র কথা বলা হচ্ছে, সে নিয়ে তৈরি হত বিভ্রান্তি আর রসিকতা দুই-ই। তবে কলকাতার লোক যে ছাতা হারাত তার প্রমাণ শিবরাম চক্রবর্তী। ছাতা কিনতে গিয়ে একটা নয়, তিন-তিনটে ছাতা কেনার কথা লিখেছেন তিনি। একটা নিজের জন্য, বন্ধুকে ধার দেওয়ার জন্য একটা, আর তৃতীয়টিও নিজেরই জন্য— কারণ প্রথম ছাতাটা তো অচিরেই হারাবে!
ছাপোষা লোকে কি আর তিনটে ছাতা কিনতে পারে! উনিশ শতকের কলকাতায় ছাতা ছিল সর্বসাধারণের নাগালে বাইরে, ব্যবহার করতেন বাবুরা। বাবুর মাথায় ছাতা ধরার আলাদা ভৃত্য থাকত। ছাতার আকার বুঝিয়ে দিত ছত্রধারীর সামাজিক অবস্থান। বিদ্যাসাগরের ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজের অন্য অধ্যাপকরা সাধারণ কালো কাপড়ের ছাতা নিয়ে কলেজে আসতেন, আর জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন আসতেন ভৃত্যের কাঁধে দশ-বারো হাত পরিধির ছাতা চাপিয়ে তার ছায়ায় হেঁটে। যাঁদের ব্যক্তিগত ছাতাবাহক থাকত না, তাঁরা পরিষেবা নিতেন ছাতাওয়ালাদের। ছাতা-সমেত বাহক হিসেবে ভাড়া খাটতেন যে শ্রমজীবী মানুষেরা, পোদ্দার কোর্ট অঞ্চলে তাঁদের পুরনো আড্ডার জায়গাটা আজও ‘ছাতাওয়ালা গলি’ নামেই পরিচিত। ১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স ছাতা তৈরি করেন হালকা সরু রড দিয়ে। সোনা, রুপো, চামড়া, শিং, বেত ও হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হত হাতল। কলকাতায় আমদানি হত সে সব ছাতা, কিনতেন শহরের অভিজাত মানুষেরা। শৌখিন অংশ বাদ দিয়ে হালকা ছাতার আমদানি ক্রমে ছাতার ব্যবহার সর্বজনীন করে তুলল। ছাতা উঠে এল সাধারণের মাথায়।
বাঙালির ছাতা ব্যবসার কথাও না বললেই নয়। ১৮৮২ সালে, ২৬ নং বেনিয়াটোলা লেনে নিজের বসতবাড়িতেই ‘কুটির শিল্প’ হিসেবে ছাতার উৎপাদন শুরু করেন মহেন্দ্রলাল দত্ত। সে অর্থে এই ব্যবসা একেবারেই কলকাতার উদ্যোগ। পরে তা সরে আসে গড়িয়াহাটে। এখন ছাতার চৌদ্দ আনাই আমদানি হয় তাইওয়ান থেকে। এ শহরে ছাতা ব্যবসার মরসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর, জানালেন ‘মহেন্দ্রলাল দত্ত’ বা ‘এমএলডি আমব্রেলা’-র বর্তমান কর্ণধার অর্ণব দত্ত। করোনার প্রকোপে ধাক্কা খেয়েছে ব্যবসা, তবু চলছে ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই।
মাথা ও ছাতার সম্পর্ক নিয়ে নিঃসংশয় রবীন্দ্রনাথও। যথাকর্তব্য কবিতায় রোদ-বৃষ্টি নিয়ে ছাতার অনুযোগের উত্তরে মনে করিয়ে দিয়েছেন, মাথার গুরুত্ব বুঝে তাকে রক্ষার মধ্যেই ছাতা-জীবনের সার্থকতা। শ্রাবণ সমাগত, বৃষ্টিভেজা কলকাতায় মাথা বাঁচানোর কাজে একনিষ্ঠ ও বিচিত্র ছাতাদের জলছবিও সে কথাই বলে।
অন্য ইতিহাস
পুরনো সংস্কার ভেঙে শব ব্যবচ্ছেদের দরকার হয়েছিল, মানুষের কাছে আধুনিক চিকিৎসা পৌঁছনোর লক্ষ্যে। ১৮৩৬ সালে দেশে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করলেন মধুসূদন গুপ্ত (ছবিতে), গড়াল ইতিহাসের চাকা। ক্রমে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজে মৃতদেহের, মরণোত্তর দেহ দানেরও গুরুত্ব বাড়ল। এ কালে মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহ দানকে আন্দোলনের রূপ দিয়েছেন ব্রজ রায়। গত মে মাসে তাঁর মরদেহের ‘প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি’ হয়েছে এ শহরে, এশিয়ায় প্রথম। দীর্ঘ যাত্রায় বহু মানুষের অবদানে তৈরি, এ বঙ্গে মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গ দানের ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ‘শব ব্যবচ্ছেদ থেকে দেহদান, এক অন্য ইতিহাস’ আলোচনার উদ্যোগ করেছে ইতিহাসচর্চা গোষ্ঠী ‘ভয়েজেস ইনটু দ্য পাস্ট: অতীত প্রবাহ’, আজ বিকেল ৫টায়, তাদের ফেসবুক পেজে। বলবেন সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়।
অর্পণ
সাহিত্য অকাদেমি থেকে জ্ঞানপীঠ, দেশিকোত্তম থেকে পদ্মভূষণ— তাঁর লিখন-জীবন ভূষিত নানা পুরস্কার ও সম্মানে। ব্যক্তি মানুষটি পুরস্কার নিয়ে ভাবিত ছিলেন না আদৌ; শব্দ নিয়ে যাপন দৈনন্দিন কাজ হলেও, সম্মাননা নিয়ে শব্দব্যয় করতেন না, তাঁর বোধে রুচিকটু ঠেকত। তবু, তাঁর সম্মান তো আসলে বাংলা ভাষারও মানপত্র— সেই প্রগাঢ় অনুভবের স্বাদ আরও এক বার পেলেন শঙ্খ ঘোষের অগণিত গুণগ্রাহী, অনুরাগীজন। উত্তর ভারতের ‘অমর উজালা ফাউন্ডেশন’ প্রতি বছর হিন্দি ও অন্য একটি ভারতীয় ভাষার এক জন লেখককে ভূষিত করে ‘শব্দ সম্মান’-এ— অর্পণ করে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘আকাশদীপ’, অনুবাদে ‘ভাষা-বন্ধু’ সম্মাননা। ২০২০ সালের আকাশদীপ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন শঙ্খবাবু। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর সূত্রে আরও এক বার মানী হল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। গত বার এই সম্মাননা পেয়েছেন গিরিশ কারনাড।
অর্ঘ্য
১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন, ২৬ জুলাই রজনীকান্ত সেনের। রবীন্দ্র-সমকালীন বাংলা কাব্য ও সঙ্গীতজগতে ভাস্বর এঁরা দুজনেই, একুশ শতকের কলকাতায় তাঁদের সঙ্গীত-পরম্পরার চর্চাকারী শিল্পী ও শিক্ষার্থী সংখ্যায় বেশি না হলেও, এই গানের ধারা জলহাওয়া পায় তাঁদের যত্নে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্যা নূপুরছন্দা ঘোষ ও তাঁর ৯০ জন ছাত্রছাত্রী দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তের জন্মমাসে আয়োজন করেছেন বারো দিনব্যাপী আন্তর্জাল-অনুষ্ঠান, ‘তিন দিশারীর সুরের ধারা’ ফেসবুক পেজে। শোনা যাবে ভক্তি, প্রেম, দেশাত্মবোধ, হাস্যরস-আশ্রয়ী গান, কবিতা; থাকবে দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যাংশের অভিনয়, অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের গানও। অনুষ্ঠান ১৯-২৯ জুলাই, রোজ সন্ধে ৭টায়। শিল্পী নিজে গানে গানে শ্রদ্ধা জানাবেন দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের জন্মদিনে।
সহযোগ
২০০২ থেকে গবেষণার পাশাপাশি প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্ট আয়োজন করেছে একাধিক আলোচনাসভা। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, বিভিন্ন পেশার মানুষ যোগ দিয়েছেন তাতে, বলেছেন কাজের পরিস্থিতিগত সঙ্কট ও সম্ভাবনার কথা। তা থেকেই উঠে এসেছে পরিকল্পনা, সমাধান। নতুন গবেষণা-বিষয়ের খোঁজ মিলেছে, প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণও। অতিমারিকালে একত্র হওয়ার সুযোগ কম, তাই আন্তর্জালে জারি থেকেছে আলোচনা, কর্মশালা। সঙ্কটকালের সম্ভাবনাগুলির বাস্তবায়নে সামাজিক যূথবদ্ধতাকে দৃঢ়তর, আলোচনাকে বিস্তৃততর করতে প্রতীচী-র উদ্যোগে তৈরি হয়েছে নতুন এক পরিসর— ‘সহযোগ’। শুরু কাল, ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ছ’টায়, ডিজিটাল মাধ্যমে।
না-লেখা বই
যে বইটি লেখা হয়নি এখনও, তাকে নিয়েও কি আলোচনা সম্ভব? সেই কাজই করছে ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব বেঙ্গল স্টাডিজ়’— আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষৎ (ভারত শাখা)। প্রতি বাংলা মাসের শুরুর দিনটিতে আন্তর্জালে অভিনব অনুষ্ঠান— এখনও অব্দি না-লেখা, লেখার পরিকল্পনা-পর্বে বা লিখতে লিখতে মাঝপথে থেমে থাকা ‘বই’টির কথা নিজমুখে বলছেন লেখকেরা। আগামী কাল, ১৮ জুলাই, শ্রাবণের প্রথম দিনটিতে ‘যে নাটক আমার এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি’ নিয়ে বলবেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র। সঙ্গে তাঁরই রচিত দু’টি নাটকের প্রাসঙ্গিক আলোচনা— ভেলায় ভাসে সীতা ও যা নেই ভারতে নিয়ে বলবেন তরুণ প্রধান ও শম্পা ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠান কাল সন্ধে ছ’টায়, সোসাইটি-র ইউটিউব চ্যানেলে।
রেস্তরাঁয় সত্যজিৎ
অতিমারির বিধিনিষেধের শহরে কফি শপ-রেস্তরাঁ খোলা থাকছে অনেকটা সময়, ভিড় কি হচ্ছে তেমন? তবে সত্যজিৎ রায়কে রেস্তরাঁয় দেখতে পেলে অন্য কথা। গোলপার্কের ‘ট্রাইব’ রেস্তরাঁয় চলছে প্রদর্শনী ‘অচেনা রে’, সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে অভিনব উদ্যোগ। একটা দেওয়াল জুড়ে সাজানো এক্ষণ পত্রিকার প্রচ্ছদ-প্রতিলিপি, সত্যজিতের ছবির চিরচেনা পোস্টারে ঝলমল আর একটা দেওয়াল। জটায়ুর লেখা রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ়ের বইগুলোর প্রচ্ছদ কেমন হতে পারত, তাও দেখার সুযোগ থাকছে— জটায়ু নামের বিশেষ উপহার-বাক্সে কুড়িরও বেশি রঙিন কার্ড, সুদৃশ্য নোটবুকও মিলছে কেনার জন্য। রেস্তরাঁ জুড়ে অন্দরশোভায় সত্যজিতের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদপট, অলঙ্করণ, ক্যারিকেচার, ক্যালিগ্রাফির পরিচয় (ছবিতে)— মেনু কার্ড, খাবারেও সত্যজিৎ-কীর্তির বিচিত্র স্বাক্ষর। পুরো জুলাই-অগস্ট জুড়েই চলবে প্রদর্শনী।
১০১ গান
যিনি লিখেছেন মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, তিনিই আবার লিখেছেন পৃথিবী আমারে চায়/ রেখো না বেঁধে আমায়। যাঁর হাতে রূপ পেয়েছে আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তিনিই লেখেন শুনি টাকডুম টাকডুম বাজে... বাংলা গানের এই বহুবিস্তারী কলমটির নাম মোহিনী চৌধুরী (১৯২০-১৯৮৭)। তিনি লেখক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালকও, ১৯৫৬ সালে নিজেরই কাহিনিতে বানিয়েছিলেন ছবি সাধনা (ছবিতে পোস্টার)। বিজ্ঞানী, লোকসভার সদস্য মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবও ছিলেন। তবু সব পরিচিতি ছাপিয়ে তাঁর গীতিকার সত্তাই মানুষ ভালবেসেছেন বেশি; তাঁর লেখা গানেই প্রথম রেকর্ড গীতা দত্ত থেকে শ্যামল মিত্র, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। গত বছর জন্মশতবর্ষ পেরিয়েছে, ১০১তম বর্ষে তাঁর পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখা ১০১টি গানের সঙ্কলন মোহিনী চৌধুরী ১০১: গানে গানে (সঙ্কলন ও সম্পাদনা: ঋতুপর্ণা সেন, উৎসব চৌধুরী)। বাংলা গানের ইতিহাসে মোহিনী চৌধুরীর অবদান নিয়ে লিখেছেন বর্ষীয়ান সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শঙ্কারূপেণ
রথের ভেঁপুই দুগ্গাপুজোর আগমনি। কাঠামোয় মাটি পড়ছে, উঁকি দিচ্ছে পূজাবার্ষিকী। কিন্তু, তৃতীয় ঢেউ এলে দুর্গা-পরিবার একলাই বসবেন ছোট্ট মণ্ডপে। ভলান্টিয়াররা ব্যস্ত টিকার লাইনে, আপনজনের স্মৃতি খুঁড়তে আসছে করোনা-সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শারদ। জানে, তাই তো বৃষ্টি এখনই বঙ্গে ঘুরছে। পুজো ধুমধাম করে হলে ঠাকুর দেখতে একেবারে আশ্বিনেই আসত, ফি-বারের মতো। এ বারও কি সেই টিমটিমে উৎসব, বন্ধ ঘরে স্বস্তিরূপিণী স্যানিটাইজ়ারই সম্বল? বাড়ির হাওয়াই, ঢোলা গেঞ্জির পুজো-বাজারই তবে ভবিতব্য?