বেপরোয়া: শিকেয় উঠল করোনা-বিধি। শারীরিক দূরত্ব না মেনে বড়দিনের সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে ঢল নামল মানুষের। মাস্ক পরতেও দেখা যায়নি অনেককে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চিত্র ১: পার্ক স্ট্রিটের এক মোমোর দোকান। ঢোকার মুখে জনা আটেকের একটি দলকে আটকেছিলেন নিরাপত্তারক্ষী। কারণ, পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়সিদের সেই দলে কারও মুখেই মাস্ক ছিল না। বাধা পেয়ে দলের এক জন ফোন করে ডেকে আনলেন দোকানের এক আধিকারিককে। মাস্ক ছাড়াই ভিতরে ঢুকতে আর কারও বাধা রইল না। খাওয়া-আড্ডা সেরে ঘণ্টা দুয়েক পরে বেরিয়ে তাঁদেরই এক জন নীলেশ কর্মকার বললেন, ‘‘করোনার জন্য ক’দিন যা হওয়ার হয়েছে। মাস্ক না পরা এখন আর অপরাধ নয়। কোনও কালেই বাঙালি মাস্কে মুখ লুকোয়নি।”
চিত্র ২: ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের থিকথিকে ভিড়। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মাস্কহীন এক যুগল প্রায় একই ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘বছর শেষ মানে করোনাও শেষ। দেখছেন না, চার দিকে সব স্বাভাবিক?”
উপরের এই দুই চিত্র বড়দিনের সন্ধ্যার। সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়িয়েছে, শহরে ভিড়ের জন্য পরিচিত জায়গাগুলিতে নেমেছে জনপ্লাবন। অনেকেই মাস্ক খুলে দেদার নিজস্বী তুলেছেন। কেউ আনন্দের আতিশয্যে মাস্ক পরে থাকারই প্রয়োজন মনে করেননি। অভিযোগ, নিশ্চুপ পুলিশ-প্রশাসনের সামনে বিধি পালন, দূরত্ব-বিধি— এই শব্দবন্ধগুলি রয়ে গিয়েছে মুখের কথা হয়েই!
শহরের এই আপাত স্বাভাবিক চেহারা নিয়েই চিন্তায় চিকিৎসকদের বড় অংশ। তাঁরা বার বার বলছেন, “শীতের এই সময়ে আরও সতর্ক পদক্ষেপ করা দরকার ছিল। সেখানে বড়দিনে উৎসবের নামে যা হল, তা আমাদের আরও কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে পারে।” চিকিৎসক কুণাল সরকার এ দিনও সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করে বেপরোয়া উৎসব-যাপন নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, “আদালত বা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান কড়া আইন না করে দিলে কি আমরা সাবালক হব না? করোনার বিপদ কত, এখনও বলে দিতে হবে?”
ওই বিপদের ভয় উড়িয়েই এ দিন পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ার গল্প শোনালেন বাগুইআটির সুমন কর্মকার। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ছাড়াও সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব শ্বশুর-শাশুড়ি আর বছর ৮২-র বৃদ্ধা মা। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে আসা তাঁদের কারও মুখে মাস্ক নেই। ভিড়ের মধ্যেই রাস্তার এক দিকে পরিবারের সঙ্গে বসে খেতে ব্যস্ত সুমন বললেন, “বয়স্ক মানুষদের অনেক রোগ আছে ঠিকই। কিন্তু করোনা ছুঁতে পারেনি। আর ছোঁবে বলে মনে হয় না।” চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার সামনে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, পেশায় স্কুলশিক্ষিকা শ্যামলী হালদারের আবার মন্তব্য, “মেয়ে মাস্ক পরতে চায় না। তাই আমিও পরিনি। বাচ্চার পিছনে এত ছুটতে হয় যে, মাস্ক পরার কথা ভাবারই সময় থাকে না।”
ময়দান চত্বরের একটি রেস্তরাঁর গেটে লেখা, ‘বিনা মাস্কে প্রবেশ নিষেধ’। কিন্তু তার সামনেই যে লম্বা লাইন অপেক্ষা করছিল, তার ছবিটা সম্পূর্ণ বিপরীত। একই চেহারা শহরের পানশালা-রেস্তরাঁগুলির সামনেও। সল্টলেক-নিউ টাউনের একাধিক রেস্তরাঁ মাস্ক ছাড়া প্রবেশ বন্ধের কথা জানালেও আদতে সবই রয়ে গিয়েছে স্রেফ নির্দেশিকায়।
এমনই একটি রেস্তরাঁর সামনে অপেক্ষা করছিলেন শর্মিলা দত্ত। মাস্ক কোথায়? প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘‘আমার মনে হয়, আমার করোনা হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেই চাকরি করি। ও সব নিয়ে আর ভাবি না।’’ তাঁর পাশেই দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তির মন্তব্য, “মাস্ক এখন শুধু গেট পাসের কাজ করে। রেস্তরাঁর গেট পেরোনোর জন্য পরে নেব। ভিতরে ঢুকে খুলে ফেলব।”
কলকাতা পুলিশের অবশ্য দাবি, এ দিনের জন্য শহরে বাড়তি বাহিনী মোতায়েন রাখার পাশাপাশি করোনা-বিধি কার্যকর করতে কড়া অবস্থান নিয়েছে তারা। রাত ৯টা পর্যন্ত মাস্কহীন ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে থুতু ফেলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ২৫ জনের বিরুদ্ধে। আটক করা হয়েছে ১৬টি গাড়ি। বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য আটক করা হয়েছে ২৩১ জনকে। মদ উদ্ধার হয়েছে ১৫ লিটার। ডিসি (ট্র্যাফিক) রূপেশ কুমার বলেছেন, “পুলিশের তরফে কড়া নজরদারি চলেছে সর্বত্র।” যদিও তার বহিঃপ্রকাশ বেশ কিছু জায়গায় দেখা যায়নি বলে অভিযোগ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ব্যক্তিগত গাড়িতে তো বটেই, মোটরবাইকেও মাস্ক পরার বালাই ছিল না। ধর্মতলা মোড়ের সিগন্যালে দেখা গেল, একটি মোটরবাইকে সওয়ার চার জন। কোথায় হেলমেট, কোথায় মাস্ক! জিজ্ঞাসা করায় বাইকচালক বললেন, “এই তো শীতের পোশাকে মাথা ঢেকে নিয়েছি। হেলমেট বা মাস্ক দিয়ে কী হবে?” একটি ট্যাক্সিতে ওঠা সাত জনের একটি দলের কেউ মাস্ক পরেছেন, কারও মুখ ফাঁকা। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, “এ বার তো হাঁটব। আর গায়ে গায়ে থাকার ব্যাপার নেই। ফলে করোনাও ধরবে না।”
সব মিলিয়ে করোনা কালের ক্রিসমাসেও বিধিভঙ্গের নজির গড়েই রাত জাগল মহানগর।