বুথে বচসায় রমলা চক্রবর্তী। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
বাড়িতে পরার আটপৌরে শাড়িটা বদলানোরও সময় পাননি। এফ ডি ব্লকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বুথটা তৃণমূল দখল করে নিচ্ছে শুনে শনিবার সাতসকালে পৌঁছে গিয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী রমলা চক্রবর্তী। তাঁর গাড়ি দেখেই রে-রে করে ঢিল-লাঠি হাতে ছুটে গেল ভিড়টা। বন্ধ জানলার কাচে পড়তে লাগল ঘুঁষি আর চাপড়। চোয়াল শক্ত করে বসে রইলেন প্রার্থী।
কোনও মতে গেট খুলিয়ে সিপিএম-প্রার্থী সহ ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ (এটিআই)-এর ভিতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন চালক। সেই ছবি ক্যামেরাবন্দী করতেই উড়ে এল নোংরা গালাগাল আর শাসানি, ‘‘সিপিএম তোদের কত টাকা দিয়েছে? এক্ষুণি চলে যা এখান থেকে। নয়তো রিপোর্টারি ঘুচিয়ে দেব।’’ রমলাদেবী তখন প্রাণপণ চিৎকার করছেন, ‘‘ওরা দরজা বন্ধ করে ছাপ্পা দিচ্ছে, সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দিচ্ছে না। বুথে সিসিটিভি-র ক্যামেরা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে দেখছেন!’’ যাদের উদ্দেশে বলছেন, সামনে দাঁড়ানো সেই পুলিশ কিন্তু পুতুলের মতো বধির, স্থানু, নির্লিপ্ত।
গাড়ি থেকে নেমে সিপিএম প্রার্থী বুথের দিকে এগোতেই উদ্ভ্রান্ত মুখে ছুটতে-ছুটতে বেরিয়ে এলেন কয়েক জন ভোটার। ‘‘কিছু করুন দিদি। সব ভোট পড়ে যাচ্ছে আমাদের।’’ সামনে দাঁড়ানো পুলিশদের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে রমলাদেবী বলতে লাগলেন, ‘‘কী করছেন আপনারা? দরজা বন্ধ করে ছাপ্পা চলছে দেখতে পাচ্ছেন না?’’ চোখেমুখে অস্বস্তি নিয়ে তড়িঘড়ি উল্টেদিকে গেটের দিকে ছুটল পুলিশেরা। আর মরিয়া রমলাদেবী দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগিয়ে ঢুকলেন একটি ঘরে।
ওই ঘরে তখন পাঁচ-ছ’জন যুবক। প্রিসাইডিং অফিসার সন্তোষ মণ্ডল মাথা নীচু করে বসে। তিন-চার জন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে রমলা চক্রবর্তী তাঁকে বললেন, ‘‘পুলিশ আপনাদের উপর দায় চাপাচ্ছে আর আপনারা পুলিশের উপর। এ ভাবে ইলেকশনটা শেষ করে দেবেন আপনারা? শুধু চাকরি রক্ষা করতে সরকারের তোষামোদ করবেন?’’ সন্তোষবাবু একই ভাবে মাথা নীচু করে বললেন,‘‘আমরা হেল্পলেস। কিচ্ছু করতে পারব না।’’
ঘরের ভিতর হতাশ, বীতশ্রদ্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রমলাদেবীর সামনেই এক জন সাদা গেঞ্জি কলার তুলে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘‘প্রার্থী হয়ে আপনি কেন এখানে এসেছেন? এসেছেনই যখন তখন শুনে যান, ৩০০-৫০০ করে ছাপ্পা দিচ্ছি, দেব। বিধাননগরে আমাদের ২৫-৩০ হাজার ছেলে ঢুকেছে। সবাই দেবে। সুভাষ চক্রবর্তী-রমলা চক্রবর্তীরাই তো এ পথ দেখিয়েছেন। এখন আপনাদের সেই ফর্মুলা ফেরত দেব।’’
ইতিমধ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে এলেন রমলা চক্রবর্তীর এক সহযোগী। ‘‘এখনই চলুন দিদি। আপনার বাড়িতে অ্যাটাক হয়েছে।’’ গাড়ি ঘুরিয়ে এফ ডি ব্লকের বাড়ির সামনে যেতেই চোখে পড়ল তেতে থাকা ভিড়টা। সেখানে অনেকেরই চোখে পড়েছে সুজিত বসু, পরেশ পাল, অর্জুন সিংহের মতো নেতাদের। এমন সময়ে উল্টে দিক থেকে ছুটে এল পুলিশ আর র্যাফের ছোট বাহিনী। মুহূর্তে গাড়ি করে হাওয়া নেতা-সমেত ভিড়টা। পরে অবশ্য সুজিত বসু এবং পরেশ পাল দু’জনেই রমলাদেবীর বাড়ি যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
এফ ডি ব্লক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ইটের উপর তখন বসে পড়েছেন ঘর্মাক্ত রমলা চক্রবর্তী। এখানেই কিছুক্ষণ আগে ইভিএম মেশিন ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। এফ ই ব্লক, এফ সি ব্লক থেকে এন্তার ছাপ্পা ভোট, এমনকী মৃত মানুষের নামেও ভোট পড়ার খবর আসছে রমলাদেবীর কাছে। বসে-বসেই স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘আর ধরে রাখা গেল না। ওরা সব বার করে নেবে। সব বুথ থেকে এজেন্ট বার করে নিতে হচ্ছে আমাদের। পুলিশ পুরো ওদের ইশারায় কাজ করছে।’’
তখনই খবর এলো, এটিআই-এর সামনে এবিপি আনন্দের সাংবাদিক আর কলকাতা টিভি-র চিত্রসাংবাদিককে ফেলে মারা
হচ্ছে। সিপিএম সমর্থক, পুলিশ সবাই ছুটলেন সে দিকে। রমলা অবশ্য থেকে গেলেন এফ ডি-র কমিউনিটি সেন্টারেই। ‘‘অন্তত এই একটা বুথে মানুষ যাতে কিছুটা ভোট দিতে পারে সেটা দেখি।’’ আশা আছে? ‘‘নাহ! এই সল্টলেক আমার অচেনা’’ — বাড়ির সামনে রাখা সুভাষ চক্রবর্তীর বড় ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন প্রার্থী।