রসিকা জৈন। ফাইল ছবি
অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে অভিযুক্তের গ্রেফতার হতে কেন লেগে গেল প্রায় দেড় বছর? আলিপুরের ব্যবসায়ী-কন্যা রসিকা জৈনের মৃত্যুর ঘটনায় বুধবার রাতে তাঁর স্বামী কুশল আগরওয়ালকে কলকাতা পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গ্রেফতার করার পরে এই প্রশ্নই তুলছেন মৃতের পরিবার এবং আইনজীবীদের বড় অংশ।
মৃতার মা সঙ্গীতা জৈন পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ তুলে দাবি করেছেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট থেকে যে রক্ষাকবচ মিলবে না, তা মঙ্গলবার পরিষ্কার হতেই পুলিশ তড়িঘড়ি কুশলকে গ্রেফতার করেছে। আগে সক্রিয় হলে এ ভাবে আইনি লড়াই লড়তে হত না।’’ পুলিশের শীর্ষ কর্তারা অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ মেনেই আইনি পথে সবটা হয়েছে। কর্তব্যে গাফিলতির প্রশ্ন নেই।’’
বিয়ের ১ বছর ৭ দিনের মাথায় গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডি এল খান রোডে শ্বশুরবাড়ির বারান্দার নীচ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার হন রসিকা। আলিপুর রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। রসিকার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে আলিপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন রসিকার বাবা-মা। রসিকার বাবা মহেন্দ্রকুমার জৈনের দাবি, মৃত্যুর আগে মেয়ে তাঁকে একটি মেসেজ লেখেন, ‘আমি আর এই পরিবারে থাকতে পারব না। আর অত্যাচার সহ্য করতে পারব না। আমি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমায় মনে করে কষ্ট পেয়ো না।’ এর ভিত্তিতেই পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি শিল্পপতির ছেলে তথা রসিকার স্বামী কুশল-সহ তাঁর পরিবারের কয়েক জনের বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করে। তার পরে প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি বলে অভিযোগ।
মৃতার পরিবারের দাবি, এফআইআর হয়েছে বুঝেই কুশল আলিপুর আদালতে অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেন। ২০২১ সালের ১৫ জুন সেই আবেদন তুলে নেন। ওই বছরই ২৪ জুলাই আলিপুর আদালত থেকে কুশলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি। বিষয়টি গড়ায় হাই কোর্টে। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি কুশলের অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন খারিজ করে কলকাতা হাই কোর্ট।
গ্রেফতারি না হওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন মৃতার পরিবার। এর মধ্যেই মেয়ের মৃত্যুর বিচার চেয়ে শহরের পথে প্রতিবাদে বসেন পরিজনেরা। শহরের দুই সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের মধ্যের এই ঘটনায় নানা মহলে চর্চা শুরু হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ‘জাস্টিস ফর রসিকা পোস্টার’।
গত ১৪ জুন আইপিএস অফিসার দমন্তী সেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। সিট তদন্ত শুরু করলেও বিষয়টি যায় সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেন কুশল। গত মঙ্গলবার জানা যায়, শীর্ষ আদালতের রক্ষাকবচ পাচ্ছেন না কুশল।
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘যখন অভিযুক্তকে সেই গ্রেফতারই করা হল, তা হলে আরও আগে কেন এই পদক্ষেপ করা হল না? এখন বহু ক্ষেত্রেই সিট গঠন হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, যে বিষয়ে থানা স্তরেই তদন্ত হওয়ার কথা, সেই বিষয়ে কেন সিট গঠন করে শীর্ষ পুলিশ আধিকারিকদের তদন্তে নামানো হবে?’’ রসিকা মামলায় যুক্ত আর এক আইনজীবী অজয় আগরওয়ালের দাবি, ‘‘অভিযুক্তেরা সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায়, বিষয়টা এত দূর গড়িয়েছে। না-হলে বহু আগে থানা স্তরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’’
ধৃত কুশলের আত্মীয় রোহিত আগরওয়ালের দাবি, ‘‘আদালতের দ্বারস্থ হয়ে যে কেউ আইনের সাহায্য চাইতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আইনি লড়াইয়ে সময় লেগেছে। পুলিশ তার কাজ করেছে।’’
এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিক অবশ্য বলেছেন, ‘‘যা করা হয়েছে, সবটাই আইন মেনে হয়েছে। গাফিলতির কোনও প্রশ্ন নেই। পরবর্তী তদন্ত প্রক্রিয়াও কড়া হাতেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।’’