সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটা সব বাবা-মায়েরাই দেখতে চান। কিন্তু চিকিৎসক যখন জানান, সে আশা আর নেই তখন যেন সব অন্ধকারে ঢেকে যায়। মায়ের মনের সেই অন্ধকার ফুটে উঠেছিল ‘পারমিতার একদিন’ চলচ্চিত্রে। সেখানে পারমিতার সন্তান সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ছিল। সন্তানের রোগের সামনে হার মানতে হয়েছিল পারমিতাকে।
বাস্তবের ‘পারমিতা’ রোগের সামনে জয়ের ধ্বজা উড়িয়েছেন। সন্তানকে সুস্থ করে তুলেছেন। এ বার তাঁর সন্তানের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পালা।
জলপাইগুড়ির বাসিন্দা কল্পনা সরকার ও সুবীর সরকারের একমাত্র ছেলে চিরঞ্জিৎ সরকার সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। ঘরে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর ইচ্ছে হত ছুটে মাঠে চলে যেতে, সকলের মতো ঘুড়ি ওড়াতে। কিন্তু মাঠে দৌড়ে যাওয়া তো দূরের ব্যাপার, পাশ ফিরে শোয়ার জন্যও মায়ের সাহায্য দরকার ছিল। তবে এখন আবার নতুন ভাবে সব শুরুর কথা ভাবছেন তিনি।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সেরিব্রাল পলসি হল মস্তিষ্ক, স্নায়ু ও পেশির সমস্যা। জন্মের সময়ে বা তার কয়েক মাসের মধ্যেই মস্তিষ্কের একটি বিশেষ কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে মস্তিষ্ক পেশিকে নড়াচড়ার নির্দেশ দিলে পেশির কাছে তা পৌঁছায় না। ফলে হাঁটাচলা করা তো দূরের ব্যাপার, পাশ ফিরে শুতেও পারেন না এই সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা।
কল্পনাদেবী জানান, চিরঞ্জিতের ন’মাস বয়সে তাঁরা জানতে পারেন সে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। কলকাতার চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, থেরাপির মাধ্যমে যতটা আরামে রাখা যায়, ততটুকুই প্রাপ্তি। সেই অনুযায়ীই চিরঞ্জিতের চলছিল থেরাপি।
কল্পনাদেবী জানান, ২০১৪ সালে তাঁরা জানতে পারেন কলকাতায় সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ১২ বছরের একটি মেয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছে। চিরঞ্জিতের সঙ্গে সেই মেয়েটির বয়সের ফারাক বছর তেইশের। তবুও তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, শুরুতেই ওজন কমাতে হবে। তখন চিরঞ্জিতের ওজন ছিল ৮০ কেজির বেশি। বিভিন্ন ওষুধ ও নিয়মে বাঁধা খাওয়াদাওয়ার মাধ্যমে তাঁর ওজন এবং শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানো হয়, যাতে অস্ত্রোপচার করতে সুবিধা হয়।
কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর অস্ত্রোপচার হয় চিরঞ্জিতের। স্পাইনাল কর্ডে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি যন্ত্র বসানো হয়। চিরঞ্জিতের মস্তিষ্কের নির্দেশ পেশি পর্যন্ত বহন করবে এই যন্ত্র। তবে অস্ত্রোপচারের পরে মাস ছয়েক নানা রকম থেরাপি চলে চিরঞ্জিতের। এ বছর জুন মাসে প্রথম নিজের পায়ে দাঁড়ান তিনি। কল্পনাদেবী বলেন, ‘‘কখনও ভাবিনি আমার ছেলে নিজে হেঁটেচলে বেড়াবে।’’ সুবীরবাবু বলেন, ‘‘অনেক দিনের লড়াই যেন সার্থক হল। তবে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে।’’
যে স্নায়ু শল্য চিকিৎসক অস্ত্রোপচারটি করেছেন সেই অনির্বাণদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, এই অস্ত্রোপচার বিরল। তাঁর কথায়, ‘‘সেরিব্রাল পলসির রোগীরা সচরাচর স্বল্প আয়ুর হন। চিরঞ্জিতের শরীরে যে যন্ত্রটি বসানো হয়েছে সেটি আধুনিক। এর কার্যক্ষমতা ২০ বছরের বেশি। ফলে শারীরিক পরীক্ষায় ওঁর কোনও অসুবিধা হবে না। এম আর আই করতে পারবেন প্রয়োজনে। আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতোই চিরঞ্জিৎ হাঁটাচলা করতে পারবেন।’’
এই অস্ত্রোপচারকে বিরল বলছেন শহরের অন্য স্নায়ু চিকিৎসকেরাও। স্নায়ু চিকিৎসক অমিতাভ চন্দ বলেন, ‘‘এই ধরনের অস্ত্রোপচার আরও বেশি হলে বহু অসহায় মানুষ বাঁচার রসদ খুঁজে পাবেন।’’
স্নায়ু চিকিৎসক পরিমল ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘কলকাতায় এই অস্ত্রোপচার স্নায়ু চিকিৎসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেল। তবে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত সব রোগীর ক্ষেত্রে এই অস্ত্রোপচার সফল হয় না। তাই এই অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার।’’