—প্রতীকী চিত্র।
কোনওটির পা ভাঙা। কোনওটির হাঁটু থেকে মাংস খুবলে বেরিয়ে এসেছে। কোনওটি আবার দু’চোখেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। অভিযোগ, এই অবস্থাতেও ময়দানে প্রমোদভ্রমণে উৎসাহী জনতার জন্য গাড়ির বোঝা টেনে চলতে হয় ন্যুব্জ ঘোড়াদের! শীতের সময়ে তাদের কদর বাড়ে বেশি, ডাক পড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানেও। কিন্তু তাতেও দিনভর তাদের খেয়াল রাখে না কেউ। এমনকি, খাওয়ানোরও লোক থাকে না। ফলে নিজের মতো করে খাবার খুঁজতে বেরিয়ে কোনওটি এসে পড়ে দ্রুত গতির গাড়ির সামনে, কোনওটির আরও করুণ পরিণতি হয়।
শনিবারই যেমনটা হয়েছে মাত্র দু’বছর বয়সি একটি ঘোড়ার সঙ্গে। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ময়দানের বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের উল্টো দিকের একটি পার্কের রেলিংয়ে বিদ্ধ অবস্থায় দেখা যায় তাকে। ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রে খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছন শেক্সপিয়র সরণি এবং ময়দান থানার পুলিশকর্মীরা। দেখা যায়, ঘোড়াটির দু’টি পা পার্কের রেলিংয়ের এক পারে ফুটপাতের উপরে। অন্য দু’টি পা পার্কের ভিতরে। পেট ফুঁড়ে ঢুকে রয়েছে পার্ক সংলগ্ন লোহার রেলিংয়ের ছুঁচলো অংশ! নড়াচড়া করার অবস্থা নেই ঘোড়াটির, শুধুই গোঙাচ্ছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য খবর যায় ঘোড়াদের নিয়ে কাজ করা একটি পশুপ্রেমী সংস্থায়। তত ক্ষণে পুলিশ নানা কায়দায় ঘোড়াটিকে বার করে আনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতই তাকে টানাটানি করা হয়েছে, ততই হাঁ হয়ে গিয়েছে পেটের কাটা অংশ। অবশেষে গেঁথে যাওয়া অংশ ছাড়িয়ে ঘোড়াটিকে বার করে আনা গেলেও তার পেটের প্রায় সব কিছু বাইরে বেরিয়ে আসে। রক্তে ভেসে যেতে শুরু করে আশপাশ। দ্রুত খোঁজ পড়ে পশু চিকিৎসকের। ঘটনাস্থলে যাওয়া পশু অধিকার আন্দোলনের কর্মী রাধিকা বসু বলেন, ‘‘কারও সাহায্য পাওয়া যায়নি। ঘোড়পুলিশে খবর দেওয়া হলেও তাদের কোনও পশু চিকিৎসক আসেননি। তাদের এক জন প্যারাভেট এসে ব্যথা কমানোর ওষুধ দেন। তাতে কোনও লাভ হয়নি। পুলিশ ঘোড়াটিকে নিয়ে বেলগাছিয়া পশু হাসপাতালে যেতে বলে। সেখানেও কোনও সাহায্য মেলেনি। এক জনও পশু চিকিৎসক এগিয়ে আসেননি, কোনও রকম চিকিৎসা উপকরণ দিয়েও সাহায্য করা হয়নি।’’
তত ক্ষণে রাধিকাদের সংস্থার অফিস থেকে এক জন পশু চিকিৎসক উপস্থিত হন। অবশেষে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা ঘোড়াটিকে ইউথ্যানেশিয়ার (নিষ্কৃতিমৃত্যু) ইঞ্জেকশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
রাধিকার অভিযোগ, এর পরে জানা যায়, ঘোড়াটির মালিক, সন্তোষ মল্লিক নামে এক ব্যক্তি তাকে ময়দান চত্বরে একা ছেড়ে রেখেই চলে গিয়েছিলেন। ফলে খাবারের খোঁজে পার্কে ঢুকেছিল ঘোড়াটি। শেষে এই পরিণতি হয়। পশুপ্রেমীদের অভিযোগ, এমন ঘটনা মাঝেমধ্যেই সামনে এলেও পরিস্থিতির কোনও বদল হয় না।
২০২১ সালে ময়দান চত্বরে ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে ‘পিপল ফর এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট ফর অ্যানিম্যালস’ (পিটা) ও ‘কেপ ফাউন্ডেশন’ নামে দু’টি সংগঠন। মামলার আবেদনে বলা হয়েছিল, এই ধরনের গাড়ি বহনকারী ঘোড়াদের স্বাস্থ্য অত্যন্ত সঙ্কটে। এদের যথেষ্ট যত্ন করা হয় না, উল্টে খাবার খুঁজে খেতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে তারা। বম্বে হাই কোর্টের একটি রায় তুলে ধরে বলা হয়েছিল, আদালত ইতিমধ্যেই এই ধরনের ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিষিদ্ধ করেছে। তা সত্ত্বেও কলকাতার বুকে তা বহাল তবিয়তে চলছে। সেই সঙ্গেই জানানো হয়, ঘোড়াগুলিকে এ ভাবে ব্যবহারের বৈধতা নেই। সবই চলছে ১৯১৯ সালের ‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, যেটি এখন অবলুপ্ত। ওই আইন অনুযায়ী, পশুতে টানা গাড়ি পরিবহণে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ময়দান চত্বরে পরিবহণ নয়, প্রমোদভ্রমণ চলে।
এর পরে ২০২২ সালের অগস্টে হাই কোর্ট একটি কমিটি গঠন করে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ময়দান চত্বরের ঘোড়ার মূল্যায়ন করে কমিটি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দু’ধরনের রিপোর্ট আদালতে জমা পড়ে। একটিতে জানানো হয়, ঘোড়াগুলির স্বাস্থ্য ভাল নয়। অন্যটিতে বলা হয়েছে, ঘোড়াগুলি ঠিকই রয়েছে। এর পরে কোর্টের নির্দেশে আরও এক বার সমীক্ষা হলে উঠে আসে, ১৬টি ঘোড়ার অবস্থা ভাল নয়। যদিও পশুপ্রেমীদের দাবি, এমন ঘোড়ার সংখ্যা অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সরকারি কোনও পক্ষই দেখাশোনায় রাজি না হওয়ায় দায়িত্ব নেয় কেপ ফাউন্ডেশন। তবে মালিকেরা ঘোড়া দিতে আপত্তি জানান। এ নিয়ে বিস্তর গন্ডগোল হয় ময়দানে। শেষ পর্যন্ত ন’টি ঘোড়া যায় ওই সংস্থায়। কিন্তু তাতেও বাকি ঘোড়াগুলির দুর্দশা যে কাটেনি, শনিবারের ঘটনাতেই তা স্পষ্ট বলে অনেকের মত।