—প্রতীকী চিত্র।
তারের জটে আকাশ দেখা যায় না। গা ঘেঁষাঘেষি করে পাশাপাশি উঠে গিয়েছে পর পর বাড়ি। পুরসভার বাতিস্তম্ভ থেকে সেই বাড়িগুলিতেই একের পর এক তার ঢুকে গিয়েছে। ওই তারের জোরেই কোনও ঘরে আলো, পাখা, টিভি চলছে। কোনওটিতে ফ্রিজ, এসি, মাইক্রোওয়েভ! বাড়ির নীচেই মাংসের দোকানে সর্বক্ষণ জ্বলছে বেশি ক্ষমতার উজ্জ্বল আলো। সেখানে কাটা মাংস রাতভর শুকোনো হয় পাখা চালিয়ে রেখে!
নারকেলডাঙা থানা এলাকার মহল্লায়-মহল্লায় চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। অভিযোগ, এখানে বেশির ভাগ বাড়িতেই মিটার রয়েছে এক জন বা দু’জনের নামে। তা-ও দুটো পয়েন্টে শুধু আলো আর পাখা চালানোর জন্য। কিন্তু রাতারাতি নির্মাণকাজ হওয়ার ফলে একতলা বাড়ি পাঁচতলা হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার পুরনো টালির চালের ঘর ভেঙে সাততলা বহুতল উঠেছে। কিন্তু বিদ্যুতের সংযোগের জন্য মিটার নেওয়া হয়নি। সামান্য কিছু টাকায় এখানে চুরির বিদ্যুতেই চলে যায় সমস্তটা। এই চুরির দৃশ্য বোঝার জন্য বিদ্যুৎ সংস্থার কর্মী হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। খালি চোখে দেখলেই মালুম হয়। এলাকার লোকজনকে প্রশ্ন করলে তাঁরাও নির্দ্বিধায় বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার খরচ প্রচুর। এখানকার দাদাদের ধরলেই কম খরচে চুরির বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। অকারণে বেশি টাকা দেব কেন?’’
বৃহস্পতিবার ভোরে একটি খুনের ঘটনায় এই বিদ্যুৎ-চুরি চক্রের দাদাগিরির বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। ওই দিন ভোরে নারকেলডাঙার কাইজ়ার স্ট্রিটে ইমামউদ্দিন আনসারি নামে এক যুবককে কুপিয়ে খুন করা হয়। তাঁর দেহ উদ্ধারের পরে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, স্থানীয় এক গোষ্ঠীর সঙ্গে ইমামউদ্দিন-গোষ্ঠীর বেশ কিছু দিন ধরে গোলমাল চলছিল। দু’পক্ষই স্থানীয় নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ফ্ল্যাট বিক্রি শুধু নয়, সেখানে থাকতে গেলে বিদ্যুৎও নিতে হয় এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও একটির কাছ থেকে। এলাকায় বেআইনি পার্কিং ব্যবসাও ওঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ। অতীতে ওই এলাকায় একসঙ্গে কাজ করলেও বর্তমানে বখরা নিয়ে মতপার্থক্যের জেরে দু’পক্ষের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়। কংগ্রেসের তরফে যদিও দাবি করা হয়েছে, খুন হওয়া যুবক ওই এলাকায় তাঁদের ওয়ার্ড সভাপতি ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। যদিও পুলিশ জানাচ্ছে, ইমামউদ্দিনের নামেই থানায় বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ রয়েছে। কিছু দিন তিনি ফেরার ছিলেন। এলাকায় ফিরতেই খুন হন।
এই সূত্রেই খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে ইমামউদ্দিনের প্রধান বিরোধী মহম্মদ শাহিদ। ইমামউদ্দিনকে খুনের ঘটনায় আরও চার জনের সঙ্গে তিনি আপাতত পুলিশি হেফাজতে। জানা গেল, দু’পক্ষেরই নিজস্ব দল রয়েছে চুরির বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যবসা চালানোর জন্য। সেই দলে থাকা কয়েক জন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। তাঁরা বিদ্যুৎ সংস্থা সিইএসসি-র প্লাস্টিকের বর্ম লাগানো তারের উপরের স্তর কেটে ভিতরের অংশ বার করে আনেন। এর পরে হুকিং করা শুরু হয়। তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ টেনে দেওয়া হয় ওই এলাকার বাড়িতে বাড়িতে। পুরসভার বাতিস্তম্ভ থেকেও একই ভাবে চুরি হয় বিদ্যুৎ। এর পরে এক দল থাকেন, যাঁরা বিদ্যুতের দাম ঠিক করেন। যেমন, একটা পাখা, আলো আর টিভি চালাতে হলে মাসে দিতে হয় ৩০০ টাকা। এর সঙ্গে এসি যুক্ত হলে দর বেড়ে হয় ৫৫০ টাকা! ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন চালালে খরচ আরও ১০০ টাকা বেশি। সব মিলিয়ে ৬৫০ টাকা দিতে পারলেই হল! অভিযোগ, এই ভাবে তোলা লক্ষ লক্ষ টাকা নানা হাত ঘুরে যায় উপরতলা পর্যন্ত।
কিন্তু পুলিশ ব্যবস্থা নেয় না? লালবাজারের কর্তাদের দাবি, সিইএসসি জানালে তাদের সঙ্গে এলাকায় অভিযানে যায় থানা। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ ঘুরে যাওয়ার পরেই অবস্থা হয়ে যায় যে-কে-সেই! সিইএসসি-র লস কন্ট্রোল সেল (লোকসান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) সূত্রের খবর, শুধু নারকেলডাঙা নয়, একবালপুর, মোমিনপুর, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজের মতো জায়গাতেও এক অবস্থা। পরিস্থিতি আলাদা নয় কামারহাটি, রাজাবাজার, এন্টালি, চিৎপুর, কাশীপুর, তপসিয়া, তিলজলার মতো এলাকাগুলিতেও। সিইএসসি-র জেনারেল ম্যানেজার অরিজিৎকুমার বসু বললেন, ‘‘এই চুরি আটকাতেই নতুন প্রযুক্তির কেব্ল ডিস্ট্রিবিউশন পিলার বক্স বসানো হয়েছে। মিটার বোর্ডও সুরক্ষিত করা হয়েছে।’’ তবে চুরি সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়নি। সূত্রের খবর, শুধু চুরির জন্যই বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির বছরে লোকসান হচ্ছে কয়েকশো কোটি টাকা।
তা হলে উপায়? সদুত্তর নেই কোনও তরফেই।