নজরে নেই: বাইপাসের বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়ে দেখা নেই পুলিশের। সেই সুযোগে সিগন্যাল না মেনেই চলছে যানবাহন। বাইকচালকের মাথাতেও নেই হেলমেট। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
এক যাত্রায় না হোক, এ যেন এক রাস্তায় পৃথক ফল!
যে রাস্তার একটি মোড়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বুধবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে আসরে নামতে হয়েছিল, বৃহস্পতিবার সেই ইএম বাইপাসেই দেখা গেল, পুলিশি দায়িত্ব পালনের দুই বিপরীত ছবি। এক জায়গায় পুলিশ অতিমাত্রায় সক্রিয়। অন্যত্র ঢিলেমির সেই পুরনো দৃশ্য। যা দেখে অনেকেরই প্রশ্ন, তা হলে কি মুখ্যমন্ত্রী না বললে বাইপাসের বাদবাকি অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না?
বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন চিংড়িঘাটা মোড়ের একের পর এক দুর্ঘটনা নিয়ে। এ দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেল, পথচারীদের উদ্দেশে রাস্তার দু’পাশে তারস্বরে মাইকে প্রচার চালাচ্ছে পুলিশ। ওয়াকিটকি হাতে আধিকারিকেরাও যান নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেচাল দেখলেই পথচারীদের দেওয়া হচ্ছে বকুনি। গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে ফুটপাত।
অন্য দিকে, বাইপাসেরই বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়ে দেখা গেল, রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েক জন সিভিক ভলান্টিয়ার। হেলমেট ছাড়াই সল্টলেকের দিক থেকে কাঁকুড়গাছি অভিমুখে মোটরবাইক চালিয়ে চলে গেলেন এক জন। সিগন্যাল সবুজ দেখেও দৌড়ে রাস্তা পেরোচ্ছেন পথচারীরা। কলকাতা বা বিধাননগর, কোনও পুলিশেরই দৃষ্টি নেই সে দিকে।
প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে দু’টি দুর্ঘটনায় এক পথচারী ও এক বাইকচালকের মৃত্যু হয়েছে চিংড়িঘাটা ও তার কাছে সুকান্তনগরের লোহাপোলের কাছে। দু’টি দুর্ঘটনাস্থলই বিধাননগর (দক্ষিণ) থানা এলাকায়।
বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মধ্যমগ্রামে প্রশাসনিক বৈঠকে মন্তব্য করেন, কলকাতা ও বিধাননগর, এই দুই কমিশনারেটের ‘ইগো’র লড়াইয়ের কারণেই দুর্ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। চিংড়িঘাটায় আর যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, তা দেখতে দুই কমিশনারেটকেই যৌথ ভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি।
এ দিন সকালে চিংড়িঘাটায় গিয়ে দেখা যায়, কলকাতা ও বিধাননগরের পুলিশ যৌথ ভাবে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ ও পথচারীদের রাস্তা পারাপার করাচ্ছে। বাইক আরোহীরা যাতে হেলমেট পরেন এবং পথচারীরা যাতে রাস্তা পেরোনোর সময়ে কানে মোবাইল বা হেডফোন না রাখেন ও জ়েব্রা ক্রসিং ব্যবহার করেন, তার জন্য মাইকে প্রচার চলছে।
কিন্তু চিংড়িঘাটা ছাড়িয়ে বেলেঘাটা মোড়, হায়াত মোড় বা বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়ে গেলেই কড়াকড়ির সেই ছবি উধাও। যা নিয়ে পথচারীদের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কি শুধুই চিংড়িঘাটার নিরাপত্তার কথা ভাবতে বলেছেন পুলিশকে? না কি চিংড়িঘাটাকে সামনে রেখে সমগ্র বাইপাসেরই নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করতে বলেছেন? দুর্ঘটনা তো যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে।’’
বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়ে দেখা গেল, পদে পদে বিধি ভাঙছেন পথচারী ও বাইকচালকেরা। বেলেঘাটামুখী রাস্তার সিগন্যাল সবুজ থাকা সত্ত্বেও এক রিকশাচালক নিজের সন্তানকে রিকশায় বসিয়ে দত্তাবাদের দিকে চলে এলেন। যদিও সামনেই তখন দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত সিভিক ভলান্টিয়ার। স্থানীয় এক চায়ের দোকানির কথায়, ‘‘অফিসটাইমে সার্জেন্টকে ঘুরতে দেখা যায়। এখানে পুলিশ রাস্তা পারাপারের নিয়ম জানিয়ে কোনও ঘোষণা করে না। মানুষ ইচ্ছেমতো রাস্তা পারাপার করেন।’’
কয়েক বছর আগের এক রাতে ওই এলাকারই পূর্বাশা মোড়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় এক মহিলার। হায়াত মোড়, বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড় বা পূর্বাশা মোড়ে বাইপাসের দু’দিকেই বস্তি রয়েছে। ওই সব জায়গায় ডিভাইডারের ফাঁক গলে ইচ্ছেমতো বস্তির বাসিন্দারা রাস্তা পারাপার করেন। কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, বাইপাসে গত এক বছরে তাদের অংশেই দুর্ঘটনায় ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে।
উল্টোডাঙায় স্লিপ রোডের কাছে দেখা গেল, চলন্ত গাড়ির মধ্যে দিয়েই রাস্তা পেরোচ্ছেন লোকজন। হায়াত মোড়ের কাছে বিনা হেলমেটেই দিব্যি চলেছেন বাইকচালক। ফলে প্রশ্ন ওঠে, নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতার বার্তা ওই সব মোড়েও কেন প্রচারিত হবে না? কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘মাইকে ঘোষণা না হলেও পুলিশের নজরদারি সব মোড়েই রয়েছে। কানে মোবাইল কিংবা হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা পেরোলে বা অন্য কোনও পথ-নিরাপত্তা বিধি ভাঙলে সব জায়গাতেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চিংড়িঘাটায় পর পর দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সেখানে ট্র্যাফিক ব্যবস্থায় বাড়তি জোর দেওয়া হয়েছে।’’
বিধাননগর কমিশনারেটের এক পদস্থ কর্তা অবশ্য এ দিন দাবি করেন, ‘‘সর্বত্র যে একই দিনে প্রচার চালাতে হবে কিংবা যৌথ ভাবে কাজ করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। যখন যেমন প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমরাও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে প্রয়োজন মতো যৌথ ভাবে কাজ করি।’’