জুলুম: যাত্রী পর্যাপ্ত হলেও যথেচ্ছ ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠছে অটোচালকদের বিরুদ্ধে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
প্রথমে ভাড়া ছিল যাত্রী পিছু ১০ টাকা। নিয়ম মেনে চার জন নিলে মোট ভাড়া হত ৪০ টাকা। রুট দেখতেন যিনি, করোনার পরে সেই দাদাই নিয়ম বেঁধে দিলেন, দূরত্ব-বিধি রাখতে তিন জনের বেশি তোলা যাবে না। যাত্রী পিছু ভাড়া ১৫ টাকা। অর্থাৎ, এক জন কম নিয়েও আয় ৪৫ টাকা!
করোনার বিপদ এখনও বর্তমান। তবু চার জনের কম যাত্রী নিয়ে অটোর চাকা গড়াতে চান না বেশির ভাগ চালক। তবে দাদার ঠিক করা নিয়মে এখনও মাথাপিছু ভাড়া ১৫। ফলে চার জন যাত্রী নিয়ে মোট আয় ৬০ টাকা! ভাড়া বেশি যখন, চার জন তুলছেন কেন? অরবিন্দ সরণির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা অটোচালকের উত্তর, ‘‘অত প্রশ্ন শুনব না। বাড়তি ২০ টাকার পুরোটাই আমরা পাই কি না, আগে খোঁজ করে আসুন।’’
শহরজীবনের যে বিষয়গুলির উপরে অতিমারির প্রভাব সব থেকে বেশি পড়েছে, তার অন্যতম গণপরিবহণ ব্যবস্থা। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর তাগিদে কিছু পরিবহণের গুরুত্ব যেমন বেড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে যাত্রী কমেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, যে বিষয়টি বদলায়নি তা হল গণপরিবহণে দাদার-দাপট! কিছু ক্ষেত্রে তা আগের চেয়েও বেড়েছে বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর জন্য ১০টি ৪ তলা বাড়ি! খরচ প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি
আরও পড়ুন: শাহ যখন লাইভ শোয়ে, চুপচাপ রাজ্য চষছেন তাঁর ‘সপ্তরথী’
যেমন, দাদা ‘পাশে আছেন’ এই আশ্বাসে কোন রুটের অটো কোথায় চলছে বহু ক্ষেত্রেই তার ঠিক নেই। দেদার বেড়েছে কাটা রুটে অটো চালানোর ঝোঁক। আইন মেনে চলা তো দূর, দাদার ‘আর্শীবাদে’ লাইসেন্স ছাড়াই অনেকে বসে পড়ছেন চালকের আসনে। ধরপাকড়ে গিয়ে পুলিশের অভিজ্ঞতা, ধরা পড়া দু’টি অটোর নম্বরই এক!
সমান তালে রয়েছে বাড়তি ভাড়া হেঁকে হলুদ ট্যাক্সির যাত্রী প্রত্যাখ্যান। শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশনের মতো জায়গায় তাদের ভিড়ে রেল যাত্রীদের জীবন অতিষ্ঠ। ট্র্যাফিক বিধি হেলায় উড়িয়ে রাতারাতি সেখানে কিছু স্ট্যান্ডও তৈরি হয়ে গিয়েছে। রাত বাড়লেই আবার শহরের রাস্তা থেকে উধাও হচ্ছে বাস। অভিযোগ, যাত্রী কম থাকায় রুট শেষ করার আগেই অনেক বাস মাঝপথে যাত্রীদের নামতে বলছে।
ফুলবাগান-শিয়ালদহ রুটের এক অটোচালক বললেন, ‘‘রুটের দাদার সমর্থন না থাকলে আমাদের পক্ষে এ সব করা কি সম্ভব? রুট যিনি দেখেন, তিনিই এক দিন বলেন, করোনা চলে গিয়েছে। এ বার ইচ্ছে মতো লোক তোল। বললাম, ভাড়ার কী হবে? তিনি বলেন, ভোটের আগে টাকার চাপ হবে। ভাড়া কমানো যাবে না। বাড়তি টাকাটা আমার
ছেলেরা বুঝে নেবে।’’ গড়িয়া-গোলপার্ক রুটের এক চালকের দাবি, ‘‘ভোটের আগে হাতে রাখতেই নতুন ছেলেদের পুরনো গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে দাদারা।’’ কলকাতা স্টেশনের কাছে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা এক ট্যাক্সিচালকের মন্তব্য, ‘‘আমরা বাড়তি ভাড়া নিলে দোষ? ইউনিয়নের লোক আর যেখানে ট্যাক্সি দাঁড় করাব সেখানকার লোকেরা দিনে কত করে নেন, ধারণা আছে?’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসমালিক সংগঠনের এক নেতার মন্তব্য, ‘‘তেলের দাম আকাশছোঁয়া, তবু ভাড়া বাড়ানো হল না। এ দিকে যার যেখান থেকে টাকা তোলার, সব তুলছে। ভোট পর্যন্ত সব দিকেই করে খাওয়ার স্থিতাবস্থা থাকবে।’’
প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী এই টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে কড়া অবস্থানের কথা আগে বললেও এ নিয়ে পরিবহণ দফতরের কেউই মন্তব্য করতে চাননি। শাসক দলের প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শম্ভুনাথ দে বলছেন, ‘‘কিছু ট্যাক্সিচালক নিজেরাই অসভ্যতা করেন। এখন কোথাও কাউকেই টাকা পাঠাতে হয় না।’’
দক্ষিণ কলকাতার অটো রুটগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা আইএনটিটিইউসি-র সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তী ফোন ধরেননি বা মেসেজের উত্তর দেননি। উত্তর কলকাতার আইএনটিটিইউসি নেতা মানা চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘কিছু যাত্রী চালকদের কথা ভেবে নিজেরাই বেশি টাকা দেন।’’ (চলবে)