নব্বইয়ের দশক অবধিও মধ্যবিত্তের কাছে অর্থের প্রদর্শন খুব সম্মানের বিষয় ছিল না। প্রতীকী ছবি।
নব্বইয়ের দশক অবধিও মধ্যবিত্তের কাছে অর্থের প্রদর্শন খুব সম্মানের বিষয় ছিল না। মনে পড়ে, একটি সাদা খামে ভরে গৃহশিক্ষকের সাম্মানিক এমন ভাবে দেওয়া হত, যেন খুব অপরাধমূলক কোনও কাজ করা হচ্ছে। এই যে ‘ভাব’ বা শারীরিক ভাষা এও ভাষাতত্ত্বে সেমিওটিক্সের অন্তর্ভুক্ত। এই সাঙ্কেতিক ভাষার মাধ্যমে আমরা সহজেই শিখতাম যে শিক্ষকেরমূল্য অর্থের দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। গৃহশিক্ষকদের সঙ্গে কখনও কোনও চুক্তি হত না, ছিল নারসিদের বন্দোবস্ত। আস্থা আর সম্মানের উপর ভরসা করেই অর্থের লেনদেন হত। সমস্ত শিক্ষকই যে এর পূর্ণ যোগ্য ছিলেন, তা হয়তো নয়, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থের এই লেনদেন গুরুত্ব দিয়ে মনে পড়ে আমাদের।
আজকের নানা নিয়ম-নীতি অনুযায়ী, এই অর্থ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তোলা সম্ভব। সে দিন এ সব মাথায় আসত না মধ্যবিত্তের। তবে কি মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের চিন্তা ছিলনা? বরং সঞ্চয়েরই চিন্তা ছিলবেশি, ব্যয়ের কম। অর্থের নগ্নপ্রদর্শনে উচ্চবিত্তেরও ছিল অরুচি। প্রকৃত উচ্চবিত্ত ধরা হত তাঁদেরই, যাঁদের বিত্তের সঙ্গে নান্দনিকতার যোগ ছিল। কারণ, যাতে অর্থের প্রদর্শন ঢাকা থাকতে পারে নান্দনিকতার আড়ালে। বাকিদের চলতি কথায় বলা হত ‘পয়সাওয়ালা’।
১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের হাত ধরে ভারতবর্ষে এল ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’ যাকে সহজ করে বলা হয় ‘ওপেন ইকোনমি’ বা মুক্ত অর্থনীতি। তার পরই ভারতবর্ষের সামনে খুলে গেল বিশ্বের বিশাল বাজার। মধ্যবিত্ত সঞ্চয় ছেড়েবেশি করে মন দিল ব্যয়ে। মধ্যবিত্তের মধ্যেও ভাগ হয়ে গেল- নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্তেরাতলিয়ে গেল বি পি এল (বিলো পভার্টি লাইন) কার্ডের দিকে। আর উচ্চবিত্ত বলতে বিশাল ব্যবসায়ী পরিবারেরাই শুধু রইল।
অর্থের কিংবা নান্দনিকতার কি কোনও আধিপত্য ছিল না পূর্বে? ছিল। কিন্তু মুক্ত অর্থনীতির পরবর্তী সময়ে এল ব্র্যান্ডেড দ্রব্যের আধিপত্য। অর্থই কেবল ক্ষমতার মূলে আর রইল না, এমনকি রইল না নান্দনিকতাও। সেই অর্থ দিয়ে কেনা দ্রব্য হয়ে গেল আধুনিক সমাজে সম্মানের প্রতিভূ। আলমারিতে অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও যদি পোশাক বা জুতো বা ব্যবহারিক কোনও দ্রব্য ব্র্যান্ডেড না হয়, তা হলে সামাজিক সম্মান জুটবে না। আগে যে পোশাক পরে সহজেই চলে যাওয়া যেত পাড়ার দোকানে, এখন আর সে পোশাক পরে যাওয়া যাবে না পাড়ার মলে।
পূর্বে এক রেস্তরাঁয় এক সাধারণ বস্ত্র পরিহিত গাড়িচালককে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এই শহর। কিন্তু ঢুকতে যদি দেওয়াও হত, ব্যবহার বা সম্মান কি যথাযথ পাওয়া যেত? উত্তরটা আমাদের জানা, যেত না।
সাম্প্রতিক সময়ে যখন দেখা যাচ্ছে, অর্থের লেনদেন নিয়ে একের পর এক গোলযোগ, রাজ্যের নানান প্রভাবশালী মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে অনেক অনেক অঙ্কের টাকা, তখন এক অভিনেতা একটিদামি গাড়ি চড়া প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “একটা পার্টিতে ঢোকার সময়ে যখন আমি সাধারণ গাড়ি থেকে নামতাম, কেউ গুরুত্ব দিতেন না। যখন বিলাসবহুল গাড়ি থেকে নামি, সবাই ‘স্যর’বলে এগিয়ে আসেন। প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাইতাই করেন।’’
আমার কাছে এই বাক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ওই অভিনেতা তার পর জানিয়েছেন, এই মানসিকতা বা অভ্যাসে তিনি কোনও ভুল দেখেন না। আমার শঙ্কা বা ভয়ের জায়গা এখানেই। মেধাহীন, অর্থ প্রদর্শনকারী ব্র্যান্ডেড দ্রব্য বহনকারীর দিকে যদি আলো, মিডিয়া, মাইক্রোফোন ছুটে যায়, তবে কি আগামী সেটাকেই ‘সম্মান’ বলে ঠাহরাবে না? তার ফলে কি আরও বাড়বে না অনৈতিক অর্থের লেনদেন? ওই অভিনেতার মতো আজকের যুবসমাজও কি এটাকেই সম্মানের মাপকাঠিহিসাবে আত্মস্থ করে ফেলবে না বা ইতিমধ্যেই ফেলেনি?
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি ওয়েব সিরিজ ‘ফারজ়ি’র কথাও মনে পড়ে। কেবল অর্থই সামাজিকসম্মান স্থির করে দিচ্ছিল বলে দু’টি যুবক নকল নোট ছাপার অনৈতিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে আর মুহূর্তে বদলেফেলে নিজেদের জীবন। এক প্রকার কিনে নিতে চায় সামাজিক সম্মান। অথচ, আমরা যে শুনেছিলাম অর্থ দিয়ে সম্মান কেনা যায় না? কিন্তু,আজ তো অর্থ দিয়ে দ্রব্য (সাজসজ্জা, ফোন, গাড়ি ইত্যাদি) আর দ্রব্যদিয়েই সম্মান কেনা যায় সবচেয়ে বেশি! আর এই কেনা নতুন সম্মানের নতুন সমাজে আমরাও তো সমান অংশগ্রহণকারী।