প্রতীকী ছবি।
তার পড়াশোনায় কি তবে এখানেই ইতি? চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রটিকে নিয়ে এখন এমনই চিন্তায় রয়েছে তার নতুন স্কুল।
কারণ, কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যায় প্রথমে ছাত্রটির মা মারা যান। তার পরে হাসপাতালের আটতলার কার্নিশ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তার বাবারও। মাসখানেকের ব্যবধানে মা-বাবা দু’জনকেই হারানো, ন’বছরের ওই বালক চলতি শিক্ষাবর্ষে এখনও পর্যন্ত এক দিনও স্কুলের ক্লাস করেনি। দেয়নি একটি পরীক্ষাও। বসেনি সদ্য শেষ হওয়া স্কুলের পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নেও। পর পর দুই অভিভাবককে হারানোর জন্যই কি ওই বালকের এমন ‘স্কুলছুট’ হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
গত ২৫ জুন মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস চত্বরে হঠাৎ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগী সুজিত অধিকারীকে হাসপাতালেরআটতলার কার্নিশ থেকে ঝুলতে দেখা যায়। পরে সেখান থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। দু’ঘণ্টার বেশি সময় পেয়েও কেন তাঁকে উদ্ধার করে নামিয়ে আনা গেল না,ঘটনার পরে সেই প্রশ্ন ওঠে। সুজিতের পরিবার পুলিশে হাসপাতালের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ আনে।
সুজিতেরই বড় ছেলে, চতুর্থ শ্রেণির ওই ছাত্রের আড়াই বছরের এক ভাইও রয়েছে।পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৫ জুনের ওই ঘটনার কিছু দিন আগেই, ৩১ মে মৃত্যু হয়েছিল সুজিতের স্ত্রী রিয়া অধিকারীর। কিডনির সমস্যা নিয়ে তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল উল্টোডাঙার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় খন্নার একটি হাসপাতালে। এর পরে রিয়াকে এসএসকেএমেস্থানান্তরিত করার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে তড়িঘড়ি লেক টাউনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। মোট ৪৭ দিন একাধিক হাসপাতালে ঘুরে শেষে রিয়ার মৃত্যু হয়। সদ্য মায়ের শেষকৃত্য সেরে ওঠা ওই বালককে এর পরেবাবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। এই মুহূর্তে ওই দুই ভাই রয়েছে সুজিতের ঠাকুরমা শিবানী অধিকারীর কাছে। বছর আশির ওই বৃদ্ধার কাছেই বড় হয়েছেন ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারানো সুজিতও।
শিবানীদেবী জানান, রিয়ার অসুখ ধরা পড়ার আগে ওই ছাত্রের লেখাপড়ার এমন পরিস্থিতি ছিল না। তৃতীয় শ্রেণির পড়া শেষ করা ছেলেকে পুরনো স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লেক টাউনের একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছিলেন সুজিত। এর কিছু দিনের মধ্যেই অসুখধরা পড়ে রিয়ার। সেই সময়ে স্কুল বন্ধ ছিল কিছু দিন। এর পরে স্কুল খুললেও স্ত্রীকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত সুজিত ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসা করতে পারতেন না। ফলে বেশ কিছু অনুপস্থিত থাকে ওইপড়ুয়া। এর পরে গরমের ছুটির আগে শুরু হওয়া পরীক্ষাও দেয়নি সে। বৃদ্ধা বলেন, ‘‘ওই সময়ে দুই ছেলেকে আমার কাছে রেখে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল সুজিত। ভেবেছিল, গরমের ছুটির পরে স্কুলে গিয়ে কথা বলে স্ত্রীর মৃত্যুর কথা জানিয়ে বড় ছেলের বিষয়টা অন্য ভাবে দেখার অনুরোধ জানাবে। তার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল!’’
স্কুল নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কথা অবশ্য এখন মাথায় নেই ওই বালকের। ছোট্ট ভাইকে আগলে রাখাই এখন তার প্রধান কাজ। সে বলে, ‘‘আমার এক কাকু স্কুলে গিয়ে কথা বলবে বলেছে। যখন যেতে হবে, স্কুলে যাব। এখন ভাইয়ের সঙ্গে খেলব। সারাক্ষণ মা আর বাবার কথা বলছে। আমি ওকে বলেছি, বাবা আমাদের জন্য চকলেট আর কাবাব আনতে গিয়েছে। এই দুটোই ওর প্রিয়।’’
ওই ছাত্রের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় বড়ুয়া বললেন, ‘‘ওই ছাত্রের বিষয়ে আমরা চিন্তায় রয়েছি। এই কারণে যদি স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে যায়, সেটা মানা যায় না। আগামী সোমবার আমি ওই ছাত্রের বাড়ি গিয়ে ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। পড়াশোনা তো হবেই, ওর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটাও দেখতে হবে।’’
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলছেন, ‘‘কোনও মতেই ওই ছাত্রের স্কুল বন্ধ করা যাবে না। আমরা সব রকম ভাবে ওর পাশে রয়েছি। এ ভাবে পরিবারের কারও মৃত্যুতে কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে না।’’