পার্ক সার্কাসে প্রতিবাদীদের জমায়েত।—ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
যে কোনও গান বা নাম তো আসলে গান বা নামই! শুধু জোর করে কিছু করতে বাধ্য করা হলেই সমস্যা হয়। পার্ক সার্কাসের মাঠে বসে বলছিলেন, ব্রাইট স্ট্রিটের বধূ তবাসুম সিদ্দিকি। তার একটু আগেই গান থেমেছে মাঠে। দিনের কাজ সেরে তবাসুমের ঢুকতে একটু দেরি হয়েছিল। তবে অ-সামান্য মুহূর্তটা প্রাণ ভরে উপভোগ করেছেন রিপন স্ট্রিটের আসমত জামিল।
সোমবার সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল পার্ক সার্কাসের মাঠ। সেই চাঁদকে সাক্ষী রেখেই শুরু হল ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’! মৌসুমী ভৌমিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তখন হাততালি দিচ্ছে গোটা মাঠ। গলাও মেলাচ্ছেন অনেকে। আসমত বলছিলেন, ‘‘এ গান তো কলেজে কতই গেয়েছি! রামের কত ভাল গুণ ছিল। বাবার কথা রাখতে সব ছেড়ে বনবাসে গিয়েছিলেন।’’ গাঁধী, অম্বেডকর, সুভাষচন্দ্রের নাম এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদী সমাবেশে। গাঁধীর প্রিয় ভজনের অভিঘাত তাই অনিবার্য ভাবে এ মাঠে ছায়া ফেলল।
বাস্তবিক তুলসীদাসের রামচন্দ্রের সঙ্গে ঘোর ফারাক আজকের ভারতে রাজনৈতিক রামের। তুলসীদাসের রামের কাছে পর-পীড়নের থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না! দেশের বৈষম্যপূর্ণ নতুন নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদের মঞ্চে যেন সেই রামেরই দেখা মিলল। এ বার বড়দিনের কলকাতায় গির্জার প্রার্থনাতেও উদ্বাস্তু জিশুর ব্যথার শরিক হয়ে সিএএ-এনআরসি-র যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ধর্মযাজকেরা। পিতৃসত্য পালনে উদ্বাস্তু হওয়া রামের কথাও এ বার উঠে এল।
পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ব্যাখ্যা, ‘‘রামের জীবনের বেশিটাই উদ্বাস্তুর মতো কেটেছে। আর রামরাজ্য মানে ন্যায় বিচারের রাজ্য।’’ নৃসিংহবাবুর মতে, ‘‘রাম ন্যায় বিচার সব সময়ে দিতে পেরেছিলেন কি না অন্য কথা! কিন্তু সিএএ-র বিরুদ্ধে লড়াইটা তো ন্যায় বিচারেরই জন্য। তাই এই মঞ্চে রামের ভজন হতেই পারে।’’ সিএএ-র
বিরুদ্ধে আন্দোলন এখন দেশের সংবিধান রক্ষার আন্দোলন। চেনা-অচেনা মসজিদ থেকে মৌলানার দল এসে সাধারণ মানুষদের নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ‘দেশ কা সংবিধান সে ছেড়ছাড় নেহি চলেগা, নেহি চলেগা’। দেশের সঙ্কটে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের হাতিয়ার আমরা ব্যবহার করতে জানি বলে, সেই অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ডাক দিয়েছেন প্রতিবাদীরা।
একই সুরে ভজন গেয়ে ডাক উঠছে, রামও কোনও রাজনৈতিক দলের যথেচ্ছাচারের সম্পত্তি নন। আসমতের কথায়, ‘‘রামের নাম কেউ ভেদভাও (বিভেদ) বাড়াতে ব্যবহার করে। এখানে গান গেয়ে ভালবাসা ছড়ানো হল।’’ তবাসুম বলছিলেন, ‘‘রাজাবাজারের স্কুলে আমরা বন্দে মাতরমও গেয়েছি। কিন্তু জবরদস্তি করলে খারাপ লাগার কথা!’’ তিনি মনে করাচ্ছেন, রফি-নৌশাদের ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ তো ভগবান, ভগবান বলে শুরু হচ্ছে। সঙ্গীতের কাছে হিন্দু-মুসলিম সব সমান।
দিল্লির শাহিনবাগে বাইবেল, কোরান পাঠ ও কীর্তনের সুর একাকার হয়েছে। দল বেঁধে পার্ক সার্কাসে গাইতে আসার আগে শেষ গানটা কী গাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল মৌসুমীর বাড়িতে। সাত্যকি, শুভঙ্কর, শ্রেয়সীরা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই গেয়ে ওঠেন, ‘ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম...’! এর পরে আর তর্কের অবকাশ হয়নি। সকলেই সহমত হয় এই গানের উপরে কথা হবে না। ‘‘ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম লাইনটায় তো ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নির্যাসও মিশে। এখানে সব ধর্ম সমান।’’— বলছেন লিঙ্গসাম্য বিষয়ে লেখক, সমাজকর্মী ফারহা নকভিও। উত্তরপ্রদেশে ফারহাদের পরিবারে নবজাতকের আসার আগে সোহর বা বিশেষ ধাঁচের গান গাওয়ার রীতি আছে। ঠাকুমার প্রিয় সোহর হল, ‘আল্লাহ মিয়াঁ হামারা ভাইয়ো কো দেও নন্দলাল’!
সম্প্রীতির সেই আবহমান দেশের দিকেই এখন তাকিয়ে প্রতিবাদের ভারত।