পথে বিকোচ্ছে সান্তা টুপি। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
দূর থেকে ভেসে আসছে ‘উই শ্যাল ওভারকাম...’।
বড়দিনের আগের পড়ন্ত বিকেলের শহর তাতে ভেসেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এই তিলোত্তমা পারে সব বাধা টপকে এগিয়ে যেতে। বড়দিন থেকে শুরু করে ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসবে প্রতি বছরই মেতে থাকে এই শহর। এ বারে অবশ্য তাতে শামিল হয়েছে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের বিকেলে হিমেল হাওয়ায় যার আঁচ অটুট। সেই উত্তাপকে সঙ্গী করে বড়দিনের আগের বিকেল থেকে রাত উৎসবে মাতল শহর।
কয়েক দিন আগেও নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতার মিছিলে পা মেলাতে কখনও শহিদ মিনার তো কখনও রামলীলা ময়দানে ভিড় জমিয়েছিলেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তাঁদেরই অনেকে এ দিন বিকেল পৌঁছে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটে। সান্তার টুপি, হরেক রকম ব্যান্ড মাথায় তাঁরা হাঁটছিলেন রাস্তার দু’ধারের ফুটপাত ধরে। চলার পথে সান্তার সঙ্গে নিজস্বী তুলে চটজলদি চকলেট উপহারও মিলছিল। কেউ আবার আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিটের ছবি ভিডিয়ো কল করে দেখাচ্ছিলেন আপনজনকে।
উৎসবের শহর কি তা হলে আপাতত ভুলে গিয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রসঙ্গ? ‘‘মোটেও নয়। সকলকে আপন করে নেওয়ার এই শহর তো বিভেদ চায় না। তাই নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় যেমন মানুষের ঢল নেমেছিল মিছিলে, তেমনই ডিসেম্বরে শেষ সপ্তাহের উৎসবেও সকলে হাজির।’’ বললেন টালিগঞ্জের বৃদ্ধা মেধা চক্রবর্তী। লাঠি হাতে ক্রিসমাস ট্রি-র সামনের দাঁড়িয়ে তিনি আরও বললেন, ‘‘বড়দিনের শহর তো সবার।’’ সত্যিই তো সান্তা ক্লজ সবারই। সেখানে তো কোনও জাত-ধর্মের ভেদাভেদ নেই। তাই পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয় ঢোকার আগে সাজানো ফুটপাতে নিজেদের ছবি তুলছিলেন কয়েক জন তরুণী। অন্য দিকে আবার সান্তার সঙ্গে নিজস্বী তোলার ফাঁকে দুই তরুণী আহেতেশাম ও লুবনা বলেন, ‘‘এ দেশ-উৎসব সবই তো আমাদের সকলের। সেখানে বিভেদ কেন?’’
‘সিটি অব জয়’-এর সঙ্গে বিভেদ ঠিক মানানসই নয় বলেই মনে করেন ওই বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে আসা হাওড়ার বাসিন্দা শুভাশিস ঘোষ। যেমনটা মনে করেন প্রেসিডেন্সির পড়ুয়া দেবশ্রী রায় ও সমর্পিতা চৌধুরী। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতার মিছিলে হেঁটেছেন ওই দুই পড়ুয়াও। ওঁদের কথায়, ‘‘এই শহর, এই দেশ যেন সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে এমনই হাসিখুশি থাকে। সান্তা ক্লজের কাছে এই উপহারই চাইব।’’
পার্ক স্ট্রিটে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। একের পর এক জ্বলে উঠছে আলোর সাজ। ঝলমলে রাস্তায় সকলে মিলেমিশে একাকার। সেই মানুষের ভিড় দেখিয়ে হায়দরাবাদে পড়াশোনা করা যুবক অংশুমান মুর্মু প্রশ্ন করলেন, ‘‘এত ভিড়ে কে কোন ধর্মের, কোন জাতের ভাগ করতে পারবেন?’’ একদা প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়ুয়া ওই তরুণ শহিদ মিনার থেকে শুরু হওয়া মিছিলে হেঁটেছেন। আর এ দিন পার্ক স্ট্রিট ঘুরে তিনিই লেন্সবন্দি করছিলেন রঙিন আলোয় পা মেলানো ঝলমলে মুখ। যেখানে সকলের পরিচয় ‘নাগরিক’।
বড়দিনের আগের রাতে পার্ক স্ট্রিটে ভিড় করা সেই নাগরিকদের কাছে সান্তার টুপি, হেয়ার ব্যান্ড বিক্রি করছিলেন মহম্মদ সাজ্জাদ, সোনি খাতুনেরা। যদিও এ বারে বিক্রি কিছুটা কম। তাও সাজ্জাদ বললেন, ‘‘বেচাকেনা কম হলে মন তো খারাপ থাকেই। কিন্তু দেশটা যেন ভাগ না হয়। এটাই বড়দিনে প্রার্থনা।’’
ফুটপাতে লাগানো চোঙায় তখন বাজছে ‘জিঙ্গল বেল্স, জিঙ্গল বেল্স, জিঙ্গল অল দ্য ওয়ে...’।