উৎকণ্ঠা: গার্ডেনরিচে এখনও খোঁজ নেই এক জনের। বিপর্যয়স্থলে উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
ঠাকুরঘর কিংবা শৌচাগার। খুব বেশি হলে ছোট একটু রান্নার জায়গা! কথা ছিল, বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে এটুকুর জন্য এ দিক-ও দিক হলে কঠোর পদক্ষেপ না-ও করা হতে পারে। কলকাতা পুরসভা মনে করলে ছাড়ের পথে হেঁটে এই ‘মাইনর ডিভিয়েশন’ (ছোট বিচ্যুতি)-এর জন্য জরিমানা করে ওই নির্মাণকে বৈধতা দিতে পারে। কিন্তু ছোট বিচ্যুতিতে ছাড় দেওয়ার এই নিয়মের ফাঁক গলেই কি পার পেয়ে যাচ্ছে বড় বড় বেআইনি নির্মাণ? গার্ডেনরিচে বিপজ্জনক ভাবে মাথা তোলা বহুতল ভেঙে পড়ে দশ জনের মৃত্যুর পরে এই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে। আশঙ্কা আরও বাড়ছে, কারণ দেখা যাচ্ছে, পুরসভার আইনে এই ছোট বিচ্যুতির উল্লেখ থাকলেও কতটা বিচ্যুতিকে ছাড় দেওয়া যাবে, তার কোনও স্পষ্ট নির্দেশই নেই!
কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘এই ফাঁকেই হাতি গলে যাচ্ছে। বেআইনি নির্মাণকে ঘুরপথে বৈধতা দেওয়ার নামে যথেচ্ছাচার চলছে। মেয়র পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে দোষ চাপালেও আদতে মেয়র পরিষদের বৈঠকেই এমন ছাড় কতটা বিচ্যুতির ক্ষেত্রে দেওয়া হবে, তা ঠিক হয়ে যাচ্ছে।’’ এই প্রেক্ষিতেই আবার পুর আইনের সঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা যুক্ত করে পদক্ষেপ করা যায় কি না, তা নিয়ে এখন ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আজ, শুক্রবার পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে পুর কর্তৃপক্ষের বৈঠক রয়েছে বলে খবর। প্রাক্তন মেয়র তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য যদিও বলছেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, কোনও বেআইনি নির্মাণকে কোনও ভাবেই বৈধতা দেওয়া যায় না। পুর আইনের মধ্যে আইপিসি ঢোকালে কী আলাদা হবে, জানি না। আদতে কাউন্সিলর, মেয়র দায় ঝাড়তে এখন আইনের সংস্থানের তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করছেন।’’
এই পরিস্থিতিতেই সামনে এসেছে, ২০১৭ সালে শহরের বেআইনি নির্মাণগুলিকে আইনি করার হিসাব খতিয়ে দেখতে কলকাতা পুরসভাকে পাঠানো ‘কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল‘ (সিএজি)-এর রেসিডেন্ট অডিট শাখার চিঠি। সেই সময়ে পুরসভা যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে জরিমানা দিয়ে বেআইনি নির্মাণকে বৈধ করার বহরে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। রিপোর্ট অনুযায়ী, বেহালায় ৯৭৪০ বর্গফুট, বাইপাসের ধারে ২৬ হাজার বর্গফুট, দেশপ্রাণ শাসমল রোডে ১৬০০ বর্গফুট এবং উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের একটি ঠিকানায় প্রায় ২০০০ বর্গফুট বেআইনি নির্মাণকে জরিমানার ভিত্তিতে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। এতেই প্রশ্ন ওঠে, প্রতিটি জায়গায় প্রায় হাজার বর্গফুটের বেশি বিচ্যুতিকে কী ভাবে ‘মাইনর’ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে? পুরসভার ব্যাখ্যা, আইন মেনেই সব হয়েছে এবং এর জন্য মোটা টাকা জরিমানাও নেওয়া হয়েছে। তবু প্রশ্ন ওঠে, টাকা দিলেই এত সহজে বৈধতা পাওয়ার এই নিয়ম কেন থাকবে? বেআইনি নির্মাণ করে এতটা সহজে কেন ছাড় মিলবে?
পুরসভার আইনজীবী শ্যামল সরকার জানান, ২০১৫ সালে রাজ্য সরকার বিধানসভায় বিল্ডিং আইনের ৪০০ ধারায় যে সংশোধন এনেছে, তাতে বেআইনি নির্মাণ হলেই পুর আইনের ৪০১ ধারায় ‘স্টপ ওয়ার্ক’ বা কাজ বন্ধের নোটিস পাঠানো যেতে পারে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট-সহ পুর আইনের ৪০০ (১) ধারায় সংশ্লিষ্ট নির্মাণ দ্রুত ভেঙে ফেলারও নির্দেশ জারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন স্পেশ্যাল অফিসার (বিল্ডিং) বা এগ্জ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। পাশাপাশি, নির্মাণকারীর বিরুদ্ধে ৪০০ (১এ) ধারায় ব্যবস্থা নিতে পারে পুরসভা। থানায় অভিযোগ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পুর আদালতে হাজিরা দেওয়ার সমন পাঠানো যেতে পারে। পরিস্থিতি অনুযায়ী, পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও সর্বাধিক সাত বছরের হাজতবাসের সাজাও হতে পারে ওই ব্যক্তির। কিন্তু এর মধ্যেই বরোর চিফ এগ্জ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার চাইলে জরিমানা বাবদ টাকা (পুরসভায় যা রিটেনশন-ফি হিসাবে পরিচিত) নিয়ে নির্মাণটিকে বৈধতা দিতে পারেন। শ্যামল বলেন, ‘‘পুর আইনের ৪০০ (৮) ধারায় মেয়র পারিষদেরাও বৈঠক করে ভাঙা বা রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। তখন ইঞ্জিনিয়ারদের আর কিছু করার থাকে না।’’ এই ফাঁক গলেই কি যেমন খুশি বহুতল উঠে যায়? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।
আরও একটি ফাঁকের কথা শোনান শহরেরই এক প্রোমোটার। তাঁর কথায়, ‘‘সম্পর্কের সমীকরণেই পুরসভা থানায় মামলা করলে, সমন আসছে বলে খবর আমাদের কাছে চলে আসে। দ্রুত আগাম জামিন নিয়ে নিতে হয় তখন। তার পরে পুর আদালতে হাজিরা দিলেই হল। এর পরে মামলা যত দিন চলে চলুক, বাড়ি তত দিনে ঠিক উঠে যায়।’’