প্রতীকী ছবি।
উইলিয়াম টলি খাল সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন প্রায় আড়াইশো বছর আগে। উদ্দেশ্য ছিল, পণ্য পরিবহণের উপযোগী জলপথ তৈরি করা। মজে যাওয়া খালকে সংস্কার করে নৌকা চলাচলের উপযোগীও করেছিলেন টলি। কিন্তু এত বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, টালি নালা নামে খ্যাত সেই খালে নৌকা চলে ঠিকই। তবে তা আবর্জনা-নোংরা পরিষ্কারের জন্য!
প্রকল্পের পর প্রকল্প! কিন্তু তার পরেও দুরবস্থা ঘোচে না টালি নালার। কারণ, ভোট-রাজনীতি সর্বস্ব রাজ্যে দখলদার উচ্ছেদের মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেবে কে? এমনটাই বলছেন পরিবেশবিদেরা। আর সে কারণেই হয়তো টালি নালা নিয়ে অন্তত ১৩টি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা দূষণমুক্ত হয় না। সেই কারণেই হয়তো বছর ছয়েক আগে জাতীয় পরিবেশ আদালত টালি নালার ধার থেকে দখলদার সরানোর নির্দেশ দিলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয় না।
অথচ তথ্য বলছে, সেই ১৯২৫ সালে ‘মাস্টার প্ল্যান’-এ নিকাশির মাধ্যম হিসেবে টালি নালাকে উল্লেখ করা হয়েছিল। তার পরে কখনও সেচ ও জলপথ পরিবহণ দফতর, কখনও কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্টে উঠে এসেছে টালি নালার প্রসঙ্গ। সরকারি নথি জানাচ্ছে, গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য ১৯৮৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের তরফে গৃহীত ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’-এর (গ্যাপ) দ্বিতীয় পর্যায়ে টালি নালাকে দূষণমুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলিও বাস্তবায়িত হয়নি বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
রাজ্য প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্তার কথায়, ‘‘তার পরেও কখনও এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে, কখনও কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (যা এখন কেইআইআইপি) মাধ্যমে টালি নালা সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি।’’
প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, টালি নালা দূষণমুক্ত করতে গেলে তরল নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট (সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা এসটিপি) এবং নিকাশির পাইপলাইন পাতা জরুরি। যার জন্য দখলদার হটানো প্রয়োজন। কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতিরই যেখানে অগ্রাধিকার, সেখানে দখলদার সরাবে কে? প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১৭ সালে টালি নালাকে দূষণমুক্ত করতে আর্থিক সাহায্যের জন্য ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’-র (এনএমজিসি) কাছে বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট জমা দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা।
সেই মতো তারা ৩০৭.১২ কোটি টাকা আর্থিক বরাদ্দও পায়। কী ভাবে প্রকল্পের কাজ এগোবে, তা নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান জমা দেওয়ার জন্য সে সময়ে নির্দেশ দেয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু তার দু’বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে সংশ্লিষ্ট মামলাটি পরিবেশ আদালতে উঠলে দেখা যায়, সেই ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তখনও তৈরি করা বাকি! সংশ্লিষ্ট মামলায় আদালতবান্ধব হিসেবে নিযুক্ত পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘কাজের গতি দেখে রাজ্যকে তখন ভর্ৎসনা করেছিল পরিবেশ আদালত।’’
জটিলতার এখানেই শেষ হয়নি। রাজ্য দাবি করে, নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে ‘রিলিজ’ করা হয়, তার জন্য এনএমজিসি দখলদার সরানো, পুনর্বাসন দেওয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সহ একাধিক শর্ত দিয়েছে। যার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির তফাত রয়েছে। অথচ গড়িয়া, গল্ফগ্রিন ও কুঁদঘাট— এই তিন এলাকায় তিনটি এসটিপি তৈরির পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেগুলির ক্ষমতা যথাক্রমে দৈনিক ৫৭ লক্ষ লিটার, ৫০.৬০ লক্ষ লিটার এবং ১ কোটি ৫৩ লক্ষ লিটার।
যার পাল্টা হিসেবে এনএমজিসি জানায়, তারা কোনও শর্ত দেয়নি। কিন্তু প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক ও জনভিত্তিক যা সমস্যা রয়েছে, তার আগে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া কত দিনের মধ্যে দখলদার সরানো হবে, সে ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেনি রাজ্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুরসভা জানায়, দখলদারদের পুনর্বাসনের জন্য ৯৬টি ইউনিট তৈরির প্রস্তাব ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পে পাঠানো হয়েছে। কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটিও ৪৩২টি পুনর্বাসনের ইউনিট তৈরির প্রকল্প রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।
তা হলে বর্তমানে কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে প্রকল্পের কাজ?
পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রথম বার দরপত্র ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তা ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত বছরে দ্বিতীয় বার দরপত্র ডাকা হয়। বর্তমানে যা ‘টেকনিক্যাল কোয়্যারি’-র পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এ বারও সাড়া না পাওয়া গেলে? এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘সে ক্ষেত্রে তৃতীয় বার দরপত্র ডাকতে হবে। কারণ, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরেই ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া যাবে। আর ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার আড়াই বছরের মধ্যে এসটিপি তৈরির কাজ সম্পূর্ণ করা হবে।’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, খাতায়-কলমে ওটা আড়াই বছর। কিন্তু পরম্পরা বলছে, টালি নালাকে দূষণমুক্ত করার
অভিযান-পর্বের সময়সীমা তো অনির্দিষ্টকালের! ফলস্বরূপ, টালি নালাকে নিয়ে প্রকল্পের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে, যেমন ভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দূষণও! (শেষ)