পন্থা: বাঁ দিকে, কোথাও লেবুর সরবতের জায়গা নিয়েছে জলজিরা। ডান দিকে, কোথাও আবার লেবু না চাওয়ার নোটিস। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘লঙ্কা নিন যত খুশি, লেবু চাইলে লবডঙ্কা’! শ্যামবাজারের একটি পাইস হোটেলে টাঙানো হয়েছে এমনই নোটিস। ক্রেতারা খেতে এসে বুঝে যাচ্ছেন, দু’বার ডাল, একটু ঝোল সবই চাওয়া যাবে, চাওয়া যাবে না শুধু লেবু।
ওই হোটেলের মালিক তপন ঘোষাল পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘‘লেবুর দাম যা বেড়েছে, তাতে লেবু বিনা পয়সায় বিক্রি করা যাচ্ছে না। লেবু নিতে গেলে অতিরিক্ত দাম দিতে হবে। একটা লেবুকে চার টুকরো করলে প্রতি টুকরো তিন টাকা দাম পড়বে। একটা ভাল মানের লেবু কিনতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকায়।’’
কলেজ স্ট্রিটের একটি পাইস হোটেলের কর্মীরা আবার জানালেন, এখনও পর্যন্ত তাঁরা লেবু ক্রেতাদের বিনামূল্যেই দিচ্ছেন। তবে তার টুকরো খুব ছোট। কিন্তু এই ভাবে লেবুর দাম বেড়ে চললে কত দিন আর বিনামূল্যে খাওয়ার পাতে লেবুর টুকরো তাঁরা দিতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান সকলেই। সে ক্ষেত্রে ভাতের প্লেটের দাম একটু হলেও বাড়বে। কারণ ভাল মানের লেবু ৮-১০ টাকা ও সাধারণ মানের লেবু মিলছে ৫-৬ টাকায়। ওই হোটেলের মালিক অরুণাংশু পাণ্ডা বলেন, ‘‘রান্নার জন্য সর্ষের তেল থেকে শুরু করে সব কিছু দামই বেশ চড়া। ভাত-তরকারি-মাছ দিয়ে প্রতি প্লেটের দাম আগের মতো রাখা বেশ কঠিন। তার মধ্যেই আবার বেড়েছে লেবুর দাম। ক্রেতাদের খুশি করার জন্য ভাতের সঙ্গে বিনামূল্যে নুন, লেবু, লঙ্কা দিতাম। ক্রেতারা চাইলে অতিরিক্ত লেবুও দিতাম। এখন সেটা করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। লেবুর দাম যা বাড়ছে, তাতে এ বার অতিরিক্ত টাকা নিতে হবে।’’ উল্টোডাঙা এলাকার এক পাইস হোটেলের মালিক আবার প্রচলিত কথা ‘‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’’-র বদলে বলছেন, ‘‘লেবু চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’’।
শুধু তো ভাত-তরকারি নয়, ফাস্টফুডের অনেক কিছুর সঙ্গেই লেবুর রস মিশিয়ে দিলে স্বাদ বাড়ে। গড়িয়াহাটের এক জনপ্রিয় রোল বিক্রেতা জানালেন, রোলের সঙ্গে লেবু দিলেও তার মান ভাল নয় বলে রস কম। ভাল লেবু দিতে গেলে পড়তায় পোষাবে না। তাই আপস করতেই হচ্ছে বলে জানালেন ওই বিক্রেতা।
গড়িয়াহাট মোড়ে বিভিন্ন রকমের চা এবং লেবুর শরবত বিক্রি করেন মিলন অধিকারী। মিলনবাবু বলেন, ‘‘লেবু দিয়ে চা-টা ম্যানেজ করে দিতে পারছি, কারণ ওতে কম পরিমাণ লেবুর রস লাগে। কিন্তু লেবুর শরবত বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। এক গ্লাস লেবুর শরবতের দাম কুড়ি টাকা নিতে হবে। কে খাবে বলুন? আবার যদি কম লেবুর রস দিয়ে শরবত বানাই, তখন আবার তার স্বাদ ভাল হবে না। যাঁরা ওই শরবত খাবেন, তাঁরা রেগে যেতে পারেন।’’ তবে ধর্মতলা, ময়দান এলাকার লেবুর শরবত বিক্রেতারা কয়েক জন জানালেন, তাঁরা আমপোড়া শরবত, পুদিনা পাতার শরবতের পাশাপাশি লেবুর শরবত এখনও রেখেছেন। এক বিক্রেতা জানালেন, লাভ কম রেখে লেবুর শরবত বিক্রি করতে হচ্ছে।
লেবুর দাম এখনই কমার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই জানালেন কোলে মার্কেটের চাষি ভেন্ডর অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কমল দে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভাল পাতিলেবু আসে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে। গত বারের পুজোয় দক্ষিণ ভারতে যা বন্যা হয়েছে, তাতে লেবুর গাছের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। ফলে এ বার দক্ষিণ ভারত থেকে লেবুর জোগান অনেকটাই কম। আমাদের রাজ্যে উত্তর ২৪ পরগনার কিছু এলাকা যেমন ঠাকুরনগর, বনগাঁ, গাইঘাটা, গোবরডাঙা থেকে পাতিলেবু বাজারে আসে। কিন্তু তা আসতে আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।’’ কমলবাবু জানান, নদিয়ার পায়রাডাঙা, রানাঘাট, চাকদহ— এই সব এলাকা থেকেও লম্বাটে দেখতে এক রকম লেবু, যাকে চিনা লেবু বলা হয় সেটা উৎপন্ন হচ্ছে। তার দাম চার থেকে পাঁচ টাকার মধ্যে। সেগুলি বাজারে আসতে শুরু করেছে। জোগান ঠিক থাকলে পাতিলেবুর দাম কিছুটা কমতে পারে।
তবে যত দিন না লেবুর দাম কমছে, তত দিন আর দোকানের সামনে লেবু-লঙ্কার মালা ঝোলাবেন না বলে জানালেন কোলে মার্কেটের এক আনাজ বিক্রেতা। তিনি বলেন, ‘‘যে ভাবে লেবুর দাম বাড়ছে, তাতে এ বার দোকানের সামনে আসল লঙ্কার সঙ্গে প্লাস্টিকের খেলনা লেবু ঝোলাব।’’