মা: দুই মেয়েকে নিয়ে জুঁই। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
১১ দিনের সন্তানকে রেখে ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছিল এক মায়ের। এ দিকে ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, বাচ্চাকে দ্রুত বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। তাই খোঁজ চলছিল সদ্য মা হওয়া কোনও মহিলার, যিনি মা-হারা সদ্যোজাতের পাশে থাকতে রাজি। এক মা প্রথমে রাজি হলেও পরে বেঁকে বসেন।
অবশেষে মায়ের দুধ পেয়েছিল সেই শিশু। রাজি হন এক সদ্যোজাতের মা। তার বদলে সেই স্তন্যদাত্রী কোনও অনুগ্রহ নেননি। অথচ, সেই তরুণী জুঁই সোয়াইনের পরিবারে অনটন লেগেই থাকে। অটো ভাড়া নিয়ে চালান স্বামী। স্বামী-স্ত্রীর পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর, ননদের মেয়ে এবং নিজের দুই মেয়ে। একটি বাড়িতে রান্নার কাজ করলেও গর্ভে সন্তান আসতেই কাজ ছাড়তে হয় তাঁকে। তবুও মা হারানো শিশুর পরিবার যখন কৃতজ্ঞতায় ফল, মিষ্টি পাঠায়, ফিরিয়ে দেয় সোয়াইন পরিবার। জুঁইয়ের প্রশ্ন, ‘‘এমন পরিস্থিতিতে কিছু নিলে মানবিকতার কি কিছু অবশিষ্ট থাকে?’’
তরুণী বলছেন, ‘‘কোনও শিশুকে বুকের দুধ দেওয়ায় মহত্ব কোথায়, আজও বুঝিনি। আমার যমজ সন্তান হলেও তো খাওয়াতাম!’’ বাগুইআটির উদয়নপল্লির ছোট্ট ঘরের জানলা দিয়ে তখন এক ফালি আলো ঢুকেছে। শরতের মায়াবী আলোয় জুঁইয়ের মুখ আরও মায়াবী দেখাচ্ছিল। সরু গলির মধ্যে সরকারি গৃহ-প্রকল্পের টাকায় ছোট্ট একটাই ঘর। যেখানে জুঁইরা চার জন, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর আর ননদের মেয়ে মিলে সদস্য সংখ্যা আট। পাশে ঘুপচি রান্নাঘর।
বছর সাতাশের জুঁইয়ের সঙ্গে ২০১৩ সালে দেখাশোনা করে বিয়ে হয় ভোলা বৈরাগীর। ২০১৬-র জানুয়ারিতে জন্মায় বড় মেয়ে শিঞ্জিনী। ভোলা বলেন, ‘‘বাবা রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তিনি অসুস্থ হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব নিই। অভাবে মাধ্যমিকের পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কেষ্টপুর-ইকো পার্ক রুটে অটো চালাই। গাড়ির মালিককে ৩৫০ টাকা রোজ দিতে হয়। তার পরে কোনও দিন ৪০০ টাকা থাকে, কোনও দিন আর একটু বেশি।’’
২০১৯ সালের ঘটনা। জুঁইয়ের ছোট মেয়ের মাসখানেক বয়স। শিঞ্জিনীর দিদিমণিই এক মহিলাকে নিয়ে আসেন জুঁইয়ের কাছে। তাঁর বোন কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল রুনু বিশ্বাস। জ্বরে আক্রান্ত আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুনু হাসপাতালে জন্ম দেন মেয়ের। প্লেটলেট কমতে থাকায় তাঁকে অন্যত্র সরায় পরিবার। বাচ্চার ১১ দিন বয়সে রুনু মারা যান। শিশুটির শারীরিক অবস্থা ভাল ছিল না। ডাক্তারদের কথা মতো মায়ের দুধ খুঁজছিল পরিবার। ‘‘সব শুনে না করার প্রশ্নই আসেনি। মানুষ হিসাবে এটুকু না করলে আর কী করলাম!’’ বললেন জুঁই। প্রতিদিন দু’বেলা জুঁইদের বাড়ি এসে দুধ নিয়ে যেত রুনুর পরিবার। এ ভাবে চলে দু’মাস।
রুনুর পরিবার আজও কৃতজ্ঞ জুঁইয়ের প্রতি। জুঁইয়ের কাছে প্রথম এসেছিলেন রুনুর মেজো দিদি রিঙ্কু আগারওয়াল। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময়ে ওঁরা সাহায্য না করলে কী করতাম, জানি না। কত কিছু দিতে চেয়েছি, নেননি। উল্টে রাগ দেখিয়ে বলেছেন, ‘কিছু দিলে দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেব।’ আমাদের বাচ্চা ভাল আছে। ২৬ অক্টোবর তিন বছর হবে।’’
বাগুইআটির উদয়নপল্লির ছোট্ট ঘরের সামনে পুজোর মণ্ডপ। আলোর মায়ায় দিনকয়েকের জন্য এলাকার অনটনে পলেস্তারা পড়ে। এ ঘরে দুর্গাপুজো আলাদা মাহাত্ম্য নিয়ে আসে না। পুজো আসে ছোটদের কাছে। হাটের জামা, পাড়ার মোড়ের বেলুনওয়ালা, সস্তার কমলা আইসক্রিমেই হৃদয় ঠান্ডা থাকে। রাত-দিন এক করে অটো চালিয়ে পুজোয় বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করেন ভোলা। পরিবারের মুখে একটি দিন মাংস তুলে দেওয়ার আশায়। সোয়াইন পরিবারের পুজোর ওটাই বোনাস। রুনুর মেয়ের জীবনে বোনাস স্তন্যদাত্রী সেই মা, যিনি সব আলোর থেকে মুখ ঘুরিয়েও আলোকিত এক জননী।