পাটুলিতে আহত সিপিএম কর্মী শৈবাল নাগ ভর্তি হাসপাতালে। —নিজস্ব চিত্র।
জনমত সমীক্ষায় বিরোধীদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে তারা। পুরভোটের বাজারে শহর জুড়ে তাদেরই আধিপত্য। কী পোস্টার-ফেস্টুন, কী মিটিং-মিছিল— সর্বত্রই কার্যত টিমটিম করছে বিরোধীরা। তবু যেন ভয় কাটছে না তৃণমূলের। তা না হলে কলকাতাবাসী ভোট দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে শাসকদলের এমন দাপাদাপি কেন?
বস্তুত, তাদের ‘ঠান্ডা’ করতে বুধবার রাত থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল তাণ্ডব শুরু করেছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। উত্তর থেকে দক্ষিণ— কোথাও মাথা ফেটে রক্ত ঝরেছে সিপিএম কর্মীর, কোথাও মঞ্চ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ায় জখম হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী, কোথাও ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে বিজেপির পোস্টার। কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ-প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। যদিও তৃণমূল যেমন বিরোধীদের উপরে চড়াও হওয়ার অভিযোগ মানেনি, তেমনই নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন।
বিরোধীদের উপরে পাল্টা দায় চাপিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, ‘‘যাঁরা ফ্ল্যাগ ছেঁড়া নিয়ে, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন, তাঁরা জেনে রাখুন, এ ভাবে জিততে পারবেন না।’’ বস্তুত, বিরোধীদের ঘাড়েই দায় চাপিয়ে দলীয় কর্মীদের ‘প্ররোচনার ফাঁদে’ পা না-দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আর মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘২১৯০টি আসনের মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে চার-পাঁচটা জায়গায় গোলমাল হচ্ছে। প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। জলভর্তি কলসি নিয়ে যেতে গেলে ছিটকে একটু জল তো পড়েই!’’
শাসক দল প্রকাশ্যে সন্ত্রাসের ঘটনা লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করলেও তৃণমূল নেতারা একান্তে স্বীকার করছেন যে, ‘চাপের মুখেই’ দাদাগিরি চালাচ্ছেন দলীয় কর্মীরা। বিরোধীদের থেকে বিস্তর এগিয়ে থেকেও কীসের চাপ? তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘বহু জায়গায় আমাদের জয় নির্ভর করে বিরোধী-ভোট ভাগাভাগির উপরে। কিন্তু এ বার তা হচ্ছে না বলেই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। তারা বলছে, বিজেপির ভোট কমছে। আর সিপিএমের ভোট ক্রমশ বেড়ে ৩০% হয়ে গিয়েছে। এটা আর ৫% বাড়লেই তো সর্বনাশ!’’
আর এক নেতা বলছেন, ‘‘এ বার ভোটারদের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া, লেক মল ও ত্রিফলা দুর্নীতি নিয়ে বিরোধীদের প্রচার ভোটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। তাই না-আঁচালে বিশ্বাস নেই!’’ আর এই কারণেই বিরোধীদের রুখতে এত কড়া দাওয়াইয়ের দরকার আছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের একাংশ। এই মতে বিশ্বাসী এক নেতার বক্তব্য, ‘‘বিশেষ বিশেষ এলাকায় কড়া ব্যবস্থা না-নিলে বিপাকে পড়তে হবে! তাই এই পথ নিতে হচ্ছে।’’
কিন্তু সন্ত্রাসের পথে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তৃণমূলের অন্দরেই। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশ বলছেন, ‘‘এ ভাবে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করলে মানুষের কাছে ঠিক বার্তা যাবে না। মানুষ সব সময়েই অশান্তি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এবং তাঁরা মনে করবেন, আমরা আত্মবিশ্বাসী নই বলেই এমন ভাবে গোলমাল করছি! এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’’
তৃণমূলের রক্তচাপ যে ক্রমশ বাড়ছে, তা আঁচ করে প্রচারে আরও আগ্রাসী হচ্ছে বিরোধীরা। শাসক দলের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার, ভোট-প্রচারের শেষ দিনে পথে নেমেছিল তারা। রাস্তা অবরোধ থেকে শুরু করে থানা ঘেরাও— কিছুই বাদ যায়নি। সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘মানুষ সন্ত্রাসের ভয়ে শাসক দলের পক্ষেই কথা বলছেন। সেই তথ্য অনুযায়ী সমীক্ষাও করা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল বুঝতে পেরেছে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে তারা অধিকাংশ এলাকায় হারবে। তাই সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষকে বুথে যেতে দিতে চাইছে না।’’ একই কথা এ দিন নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়েও জানিয়েছেন বামেরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেন, ‘‘গত লোকসভা ভোটে যেখানে তৃণমূলের ভোট বিধানসভার তুলনায় কমেছে বা পুরভোটের আগে বিরোধীদের জনসমর্থন বাড়ছে, সেখানেই শাসক দলের গুণ্ডামি চলছে!’’
কী রকম? উদাহরণ দিয়ে রবীনবাবু বলেন, ‘‘২০১১ সালে যাদবপুরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তৃণমূলের মণীশ গুপ্ত হারিয়েছিলেন সাড়ে ১৬ হাজার ভোটে। কিন্তু ওই কেন্দ্রেই লোকসভা ভোটে সুজন চক্রবর্তী তৃণমূলের সুগত বসুর থেকে ৩০৮ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। তাই যাদবপুরে সিপিএমের উপরে হামলা হচ্ছে বেশি। অন্যত্রও একই ঘটনা ঘটছে।’’ শুধু বাম নয়, যেখানে বিজেপি, কংগ্রেস বা বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থীরা শক্তিশালী, সেখানেও সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে বলে রবীনবাবুর অভিযোগ। সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কলকাতায় ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। লোকসভা ভোটে তা কমে ৩৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এই জন্যই ওরা মরিয়া হয়ে সন্ত্রাস করছে।’’
প্রায় একই অভিযোগ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাস বাংলাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এটা যদি মুখ্যমন্ত্রী না জানেন, তা হলে তা দুর্ভাগ্য! ’’ তৃণমূল নেত্রীকে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘আপনি এতই যদি সৎ হন, তা হলে আপনার দলের নেতাদের সন্ত্রাস করার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?’’
শনিবারের ভোট কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, তা নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্নের আবহেই এ দিন রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সন্ত্রাসের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। পরে তিনি জানান, ভোটারদের মনে আস্থা জাগাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার প্রয়োজন ছিল।
আর মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘মানুষকে শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে হবে।’’