আগাম গ্রেফতারি কাজের হতো, বলছে পুলিশই

থানার তালিকা ধরে ধরে সমাজবিরোধী-দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে এ বার তেমন গা করা হয়নি। অথচ এই ধরনের সতর্কতামূলক গ্রেফতারি ভোটের আগে এক রকম দস্তুর। আর এটা না হওয়াতেই শাসক দলের একচেটিয়া ভোট করানোর কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে গেল বলে শনিবার বিকেলে মানছেন লালবাজারের কর্তাদের একটা বড় অংশ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

থানার তালিকা ধরে ধরে সমাজবিরোধী-দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে এ বার তেমন গা করা হয়নি। অথচ এই ধরনের সতর্কতামূলক গ্রেফতারি ভোটের আগে এক রকম দস্তুর। আর এটা না হওয়াতেই শাসক দলের একচেটিয়া ভোট করানোর কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে গেল বলে শনিবার বিকেলে মানছেন লালবাজারের কর্তাদের একটা বড় অংশ।

Advertisement

ভোট শুরু হতে তখন মাত্র ১২ ঘণ্টা বাকি। শুক্রবার সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের এক সহকারী কমিশনার বলছিলেন, ‘‘কাল কোনও গণ্ডগোল হবে না। সব ছক রেডি। নির্ঝঞ্ঝাটে এমন ভাবে সব হবে যে, কেউ কিছু টেরই পাবে না। অশান্তি হবে না। মিলিয়ে নেবেন!’’

কিন্তু পোড় খাওয়া সেই অফিসারের কথা মিলল না। শনিবার ভোট শুরু হতে না হতেই বোঝা গেল, কাশীপুর থেকে কুঁদঘাট— শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় রীতিমতো ভোট লুঠ হচ্ছে, অনেক জায়গাতেই নির্বাচন এক রকম প্রহসনে পরিণত। কোনও ভোটার দুপুর ১২টার আগেই বুথে গিয়ে দেখছেন তাঁর ভোট পড়ে গিয়েছে, কাউকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, কোথাও আবার শাসক দলের এজেন্ট ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একের পর এক ভোটারকে বাধ্য করছেন ইভিএমে দলীয় প্রতীকের পাশের বোতামটিই টিপতে।

Advertisement

ছক যেখানে ছিল মাখনে ছুরি চালানোর মতো মসৃণ ভাবে সব কিছু করার বা নিঃশব্দ সন্ত্রাসের, সেখানে অনেক কিছুই এতটা বেআব্রু হয়ে পড়ল কেন?

গোয়েন্দাদের সাফ বক্তব্য— থানা ও গোয়েন্দা বিভাগের রাফ রেজিস্টারে নাম থাকা দাগিদের একটা বড় অংশকে আগে থেকে গ্রেফতার না করার ফলে তারা এ দিন তল্লাটে তল্লাটে খোলাখুলি সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এদের অধিকাংশেরই আনুগত্য আবার শাসক দলের দিকেই থাকে। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হাতে রাশ থাকার জায়গায় অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল ওই সব সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতীদের হাতে। আগের দিন পই পই করে বলে দিলেও বহু ক্ষেত্রেই রেখেঢেকে ‘ভোট করানোর’ ক্ষমতা ও পারদর্শিতা তাদের ছিল না। ফলে আড়ালটা খসে যেতে সময় যে বিশেষ লাগেনি, সেটা পুলিশের বহু অফিসারও মেনে নিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, সতর্কতামূলক গ্রেফতারির উপরে গুরুত্ব দিলে পরিস্থিতি হয়তো এতটা হাস্যকর না-ও হতে পারত।

লালবাজারের গুন্ডা দমন শাখা (এআরএস)-র এক ইন্সপেক্টরের বক্তব্য, সাধারণত প্রতি বার ভোটের আগে থানা এবং গোয়েন্দা বিভাগ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে ঠিক করে কারা কোন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করবে। সেই মতো অভিযান চালানো হয়, হানা দিয়ে উদ্ধার করা হয় অস্ত্রশস্ত্র, গুলি, বোমা। যাতে অন্তত ভোটের দিন ওই দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব করতে না পারে। কিন্তু এ বার সেই উদ্যোগই সে ভাবে নেওয়া হয়নি বলে জানাচ্ছেন গুন্ডা দমন শাখার ওই অফিসার। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতায় ৬৯টি থানা আছে। প্রত্যেক থানা এলাকায় গড়ে ১০-১২ জন দাগি সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতী আছে বলে ধরে নিলে সংখ্যাটা ৭০০ হয়। কিন্তু এ রকম সাত জনকেও আগাম গ্রেফতার করা হয়নি এ বার।’’

রাজ্য নির্বাচন কমিশনে কলকাতা পুলিশ অবশ্য হিসেব দিয়েছে, জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে, এমন ৩৬১০ জনের মধ্যে ১৬৫৭ জনকে ভোটের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে গুন্ডা দমন শাখার ওই ইন্সপেক্টর এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ-এর আর এক ইন্সপেক্টর বলছেন, ‘‘এই গ্রেফতারি ও সংখ্যাটা স্রেফ লোক দেখানো। আসল লোকেদের কাউকেই ধরা হয়নি।’’

লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা মেনে নিচ্ছেন, প্রিভেনটিভ অ্যারেস্ট বা সতর্কতামূলক গ্রেফতারি এ বার ‘তেমন হয়নি।’ তবে ওই কর্তার যুক্তি, ‘‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী আমরা রাফ রেজিস্টারে নাম থাকা বহু দুষ্কৃতীকে দিয়ে মুচলেকায় স্বাক্ষর করিয়েছি। এদের মধ্যে কেউ শান্তিভঙ্গের কোনও কাজ করলে সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবেন।’’ ওই কর্তার বক্তব্য, ‘‘সতর্কতামূলক গ্রেফতারির চেয়েও এটা অনেক শক্তিশালী আইনি অস্ত্র।’’

কিন্তু একাধিক থানার ওসি এবং গুন্ডা দমন শাখার অফিসারদের বক্তব্য, আইনের বিচারে কোনটা শক্তিশালী, সেটা এ ক্ষেত্রে বিচার্য নয়। ওই ৭০০ জনের মধ্যে যদি অর্ধেককে গ্রেফতার করা হত, তা হলে বাকি অর্ধেকের কাছে বার্তা যেত। তাদের গ্রেফতার করারও দরকার পড়ত না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করে আসাটাই যথেষ্ট ছিল। গ্রেফতারি এড়াতে ভোটের আগেই শহর ছেড়ে যেত অনেকে।

গুন্ডা দমন শাখার এক অফিসার বলেন, ‘‘উপর মহলের নির্দেশে সত্যিকার প্রিভেনটিভ অ্যারেস্ট তেমন হল না। কিন্তু সমস্যা হল, দিনের শেষে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মুখ পুড়ল আমাদের, আবার গুলিও খেলেন আমাদের এক সহকর্মী সাব-ইন্সপেক্টরই!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement