calcutta News

শিশু খুনে দায়ী মায়ের অবসাদ না অন্য কিছু?

প্রশ্ন উঠছে, পরিবার খুশি, অথচ স্বয়ং মা কেন এমন নৃশংস ভাবে কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলবেন?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:৩৬
Share:

শিয়ালদহ কোর্টে সন্ধ্যা মালো। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

দু’মাসের শিশুকন্যাকে নিয়ে গোটা পরিবার যখন সুখী, খোদ মা সেই শিশুকে মেরে ফেলবেন কেন?

Advertisement

প্রশ্নটা তুলে দিয়েছে বেলেঘাটার রবিবারের ঘটনা। সেখানে দু’মাসের কন্যাশিশুকে হত্যার অভিযোগে ধৃত মাকে আট দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার জন্য সোমবার নির্দেশ দিয়েছেন শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট শুভদীপ রায়। ধৃত মহিলার নাম সন্ধ্যা মালো। সরকারি আইনজীবী অরূপ চক্রবর্তী বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘‘নিজের সন্তানকে খুন করেছেন মা। এর থেকে মর্মান্তিক ও অমানবিক ঘটনা আর হতে পারে না। নিজের দোষ ঢাকতে ওই মহিলা প্রথমে পুলিশকে মিথ্যা বয়ান দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিলেন।’’ ওই আইনজীবী ধৃতকে ১৪ দিনের পুলিশি হাজতে রাখার আবেদন জানান। ধৃতের আইনজীবী চঞ্চলকুমার জৈন বলেন, ‘‘তদন্তে সত্যটা উঠে আসুক, এটাই চাই।’’

বেলেঘাটার সিআইটি রোডের একটি বহুতলে দোতলার ফ্ল্যাটে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, আট বছরের ছেলে, দু’মাসের মেয়েকে নিয়ে থাকতেন সন্ধ্যা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শিশুকন্যার মানত থাকায় সন্ধ্যার শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী ও ছেলে রবিবার সকালে উত্তর কলকাতার একটি মন্দিরে পুজো দিতে যান। পরিচারিকা ও শিশুকন্যাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ছিলেন সন্ধ্যা। বেলা ১২টা নাগাদ পরিচারিকা কাপড় মেলতে ছ’তলার ছাদে যান। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ সন্ধ্যার শ্বশুর হেমন্ত মালো ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখেন, বৌমা অচৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। জ্ঞান ফেরার পরে সন্ধ্যা শ্বশুরকে জানান, এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি এসে জানায়, পরিচারিকা ছাদের চাবি নিতে ভুলে গিয়েছে। তিনি দরজা খুলতেই ওই ব্যক্তি তাঁকে ছিটকে ফেলে দিয়ে শিশুকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। হেমন্তবাবু শিশু অপহরণের অভিযোগ করেন বেলেঘাটা থানায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: নিজের সন্তানকে এ ভাবে কেন খুন করলেন মা? কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা

পুলিশ সন্ধ্যাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ চালাতেই তাঁর কথাবার্তায় বিস্তর অসঙ্গতি ধরা পড়ে। রবিবার রাতেই ফ্ল্যাটের সামনে ম্যানহোল থেকে মুখে লিউকোপ্লাস্ট বাঁধা, গলায় ফাঁস দেওয়া শিশুকন্যার প্লাস্টিকবন্দি দেহ উদ্ধার হয়। রাতেই পুলিশ সন্ধ্যাকে গ্রেফতার করে। সোমবার পুলিশ জানায়, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী শিশুটির মুখের ভিতরে সেলোটেপ ঠেসে দেওয়া হয়েছিল। তাতেই মৃত্যু হয়। পরে নিশ্চিত হতে ফাঁস লাগানো হয় তার গলায়। মুখে সেঁটে দেওয়া হয় লিউকোপ্লাস্ট।

এ দিন ওই ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজাতে বেরিয়ে আসেন সন্ধ্যার শাশুড়ি মধু মালো। তিনি বলেন, ‘‘দু’মাসের নাতনিকে নিয়ে আমরা বেশ আনন্দেই ছিলাম। কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, জানি না।’’ কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ঘটনার পরে ওই আবাসনে সিসি ক্যামেরা বসানোর তোড়জো়ড় চলছে। আবাসন কমিটির সম্পাদক পরিমল দে বলেন, ‘‘মাস দুয়েক আগে কন্যাসন্তান হওয়ার পরে ওই পরিবার বেশ আনন্দেই ছিল। কথা ছিল, ২ ফেব্রুয়ারি শিশুটিকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা হবে। তার আগে এই ঘটনা ভাবতেই পারছি না।’’

সেই ম্যানহোল। —নিজস্ব চিত্র।

প্রশ্ন উঠছে, পরিবার খুশি, অথচ স্বয়ং মা কেন এমন নৃশংস ভাবে কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলবেন? সন্ধ্যা পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি বাচ্চাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না। তাই তাকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ জানায়, সন্ধ্যা দীর্ঘদিন ধরে অবসাদে ভুগছেন। যার পোশাকি নাম, ‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন’।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ১০০ জন মহিলার ১৫ জন এর শিকার হতে পারেন। এই রোগে আক্রান্ত মহিলারা বেশির ভাগ সময় সন্তানকে সহ্য করতে পারেন না। সন্তান-সহ নিজেকেও খুন করার কথা ভাবেন। শিশু-চিকিৎসক ও মনোবিদ অবশ্য জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে শিশু-হত্যার অন্য কারণ থাকতে পারে।

শিশু-চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানান, প্রসবের পরে কারও কারও মানসিক সমস্যা (পোস্টপার্টাম অবসাদ বা বেবি ব্লুস) হয়। অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ সন্তানকেও খুনের কথা ভাবেন। তবে সন্তানকে মারার পরে মা নিজে জড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে অবিবাহিতারা গর্ভধারণ করলে সন্তানের জন্মের পরে তাকে মেরে ফেলেন বা নিজের সন্তান মেরে ফেলার জন্য অন্যকে সাহায্য করেন। নিজে ভাল থাকব— এই ধারণা থেকেই সেটা হয়। ‘‘কিন্তু বেলেঘাটার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মেরে ফেলার পরে মা মিথ্যা গল্প তৈরি করেছেন। এটা ‘পোস্টপার্টাম’ অবসাদ নয় বলেই আমার ধারণা,’’ বলেন অপূর্ববাবু।

মনোবিদ প্রদীপ সাহার বক্তব্য, প্রসবের পরে ১৫ শতাংশ মহিলার অবসাদ হয়, যার পোশাকি নাম ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’। এই রোগে আক্রান্ত মায়ের কাছে তাঁর সদ্যোজাত শিশু ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়ায়। রোগাক্রান্ত মা প্রায়শই সন্তানকে মেরে ফেলার কথা ভাবেন। ‘‘বেলেঘাটায় মা তাঁর দু’মাসের মেয়েকে যে-কায়দায় মেরে ফেলে ম্যানহোলে লুকিয়ে তথ্য গোপন করতে চেয়েছিলেন, তাতে আমার মনে হয়, এর জন্য শুধু মহিলার অবসাদই দায়ী নয়। এই ঘটনার পিছনে অন্য কিছু কারণ থাকতে পারে,’’ বলেন প্রদীপবাবু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement