বিপজ্জনক: হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে সিলিং থেকে ঝুলছে টিনের পাত (চিহ্নিত)। রবিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
গাড়িতে যেতে যেতে কেউ সরাসরি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়েন ভেঙে পড়া সেতুর নীচে। রাজমিস্ত্রির কাজ করা কাউকে আবার সহকর্মীদের খাবার পৌঁছে দিতে হেঁটে যাওয়ার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাপা পড়ে থাকতে হয় হঠাৎই ভেঙে পড়া উড়ালপুলের তলায়। কেউ আবার একটি স্টেশনে তিনটি ট্রেনের যাত্রী পৌঁছে যাওয়ায় হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়েও সময়ে রেলের ক্ষতিপূরণ পান না। চেক ‘বাউন্স’ করে!
শনিবার রাতে বর্ধমান স্টেশনের বারান্দা দফায় দফায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে দেখে তাঁরা বলছেন, ‘‘বছর যায়, বছর আসে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না!’’ তাঁরা মনে করান, বর্ধমানের ঘটনায় এক জনের মৃত্যু হলেও ২০১৬ সালের মার্চে পোস্তা উড়ালপুল এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল একাধিক। ২০১৮ সালের অক্টোবরেই একই রকম বিপর্যয়ে সাঁতরাগাছি রেল স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। জখম হন অন্তত ১২ জন। স্রেফ পরিসংখ্যান নয়, দুর্ঘটনার ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে তাঁদের।
শনিবার রাতে যেমন বাড়ি ফিরে সবে মাত্র টিভি খুলে বসেছিলেন কলকাতা পুলিশের রির্জাভ ফোর্সের কনস্টেবল বছর সাঁইত্রিশের অনুপম সাহু। আচমকাই খবরের চ্যানেলে বর্ধমান স্টেশনের একাংশ ভেঙে পড়তে দেখে পাশে বসা স্ত্রীর হাত চেপে ধরেন তিনি। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘‘আবার!’’
গড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন বড় বটতলার বাসিন্দা ওই যুবকের মনে পড়ে যায়, কী ভাবে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে গাড়ি-সহ নীচে পড়েছিলেন তিনি! শিরদাঁড়ায় গুরুতর চোট পেয়ে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এক সময়ে। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সম্প্রতি কাজে যোগ দিয়েছেন। টিভির সামনে থেকে উঠে গিয়ে কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী পূরবীকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, ‘‘কেউ কী আটকে আছে? কী বলছে!’’ রবিবারও যুবকের গলায় একই উৎকণ্ঠা। বললেন, ‘‘গতকাল স্টেশন ভাঙতে দেখে মনে হচ্ছিল, আরও কয়েক জন আমার মতোই এক আতঙ্কের সঙ্গী হলেন।’’
একই যন্ত্রণার কথা মানিকতলা সুকিয়া স্ট্রিটের বাসিন্দা হনুমন্ত সাউয়ের গলায়। স্ত্রী কিরণ, বছর দশেকের পুত্র অকসত এবং সাত বছরের মেয়ে অর্ণাকে নিয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে কেরল ঘুরে ফিরছিলেন তিনি। কোন স্টেশনে কোন ট্রেন ঢুকছে বুঝতে না পেরে একটি ওভারব্রিজে ওঠেন। সেখানেই ভিড়ের চাপে ছাড়াছাড়ি হয়ে যান সবাই। পদপিষ্ট হয়ে গুরুতর জখম হন চার জনই। রেলের তরফে অকসত এবং তাঁর বাবাকে এক লক্ষ ৯৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। কিরণ পান ৫০ হাজার টাকার চেক। বারবার ‘বাউন্স’ করার পরে ২০ দিনের মাথায় ক্ষতিপূরণ পায় ওই পরিবার। হনুমন্ত বলেন, ‘‘বর্ধমানের ঘটনা টিভিতে দেখে মনে হচ্ছে, সকলে যে বেঁচে রয়েছি এটাই বড় কথা!’’
বেঁচে থাকার সৌভাগ্যকেই ধন্যবাদ দেন মুর্শিদাবাদ রেজিনগরের আব্দুল হুদা শেখ। পোস্তা উড়ালপুল কেড়ে নিয়েছে তাঁর কর্মক্ষমতা। বাঁ হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এখনও গার্ড বাঁধা। বাঁ পায়ের পাতাতে সাড় নেই। ডান হাতের হাড় থেকে মাংস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। জঙ্ঘার থেকে মাংস নিয়ে ডান হাতে জুড়েছিলেন চিকিৎসকেরা। বাঁ চোখেরও দৃষ্টি ক্ষীণ। হাঁটতে হয় ক্রাচে ভর দিয়েই। ভেঙে গিয়েছিল ডান বুকের পাঁজরও। জোরে দম নিতে গেলে এখনও কষ্ট হয় তাঁর। তবু দম নিয়ে হুদা বলেন, ‘‘সেতু, স্টেশনের কর্তৃপক্ষেরা আর একটু সতর্ক হোন।’’