বৈষ্ণবঘাটা রোড

পুকুর উধাও, হতশ্রী টালিনালা, তবুও শান্তি এখানেই

টলিনালার ধার ঘেঁষে এক দিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস রোড, অন্য প্রান্তে রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোড। তারই মাঝে যে এলাকাটা তার নাম বৈষ্ণবঘাটা। মজা করে বলি, আমাদের পাড়াটা ঠিক ‘স্যান্ডউইচের’ মতো। বাড়ির ঠিকানা বৈষ্ণবঘাটা রোড হলেও গোটা বৈষ্ণবঘাটা অঞ্চলটাই আমার কাছে পাড়া।

Advertisement

প্রীতিময় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০২:১৮
Share:

টলিনালার ধার ঘেঁষে এক দিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস রোড, অন্য প্রান্তে রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোড। তারই মাঝে যে এলাকাটা তার নাম বৈষ্ণবঘাটা। মজা করে বলি, আমাদের পাড়াটা ঠিক ‘স্যান্ডউইচের’ মতো। বাড়ির ঠিকানা বৈষ্ণবঘাটা রোড হলেও গোটা বৈষ্ণবঘাটা অঞ্চলটাই আমার কাছে পাড়া।

Advertisement

বাইরে থেকে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পাড়ার মতো মনে হলেও ব্যক্তিত্বে, চরিত্রে পাড়াটা আলাদা বৈকী। এই পাড়াটাই আমাকে দিয়েছে জীবনে মূল্যবোধ, সংস্কার, আরও অনেক কিছু...। শিখিয়েছে ভালবাসতে, জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলির তাৎপর্য অনুধাবন করতে। আজ বুঝতে পারি আমার জীবনে পাড়াটার প্রভাব কতটা। এখানেই বেড়ে ওঠা। শৈশব, কৈশোর, যৌবন অতিক্রম করে জীবনের উত্তরণের পথে এগিয়ে চলা।

জীবন পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের সেই ছোঁয়া অন্য পাড়ার মতো এখানেও পড়েছে। সময়ের সঙ্গে যেমন নাগরিক জীবনে উন্নতি হয়েছে, তেমনই হারিয়েছে অনেক কিছুই। এক সময় কাছাকাছির মধ্যে ছিল বেশ কিছু বড় পুকুর। সেখানে কত সাঁতার কেটেছি, ডুব সাঁতার দিয়ে পাঁক তুলে এনে বন্ধুর মুখে মাখিয়ে ফের ডুব সাঁতারে মেতেছি। তবে আজও টিকে আছে ‘কোটা পুকুর’টা। যদিও আগের চেহারায় নয়। সেই পুকুর পাড়টাই ছিল কৈশোরে-যৌবনে আমাদের ‘অপকম্মের’ আখড়া! প্রথম সিগারেট-বিড়িতে টান দেওয়া, লুকিয়ে প্রেম করা... আরও কত কিছুর নীরব সাক্ষী সে। আমার ছেলে যখন বড় হল, স্ত্রী বললেন তাকে সুইমিং ক্লাবে সাঁতার শেখাতে। সে দিন মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ তত দিনে উধাও হয়েছে আমাদের ছেলেবেলার সেই সব পুকুরগুলি। তেমনই আজকের শীর্ণকায়, হতশ্রী টালিনালাটাকে দেখে কষ্ট হয়। মনে পড়ে ছেলেবেলায় জোয়ারের সময়ে পণ্যবাহী নৌকা যাতায়াত করত সেখানে। আমরাও পরিষ্কার জল সাঁতরে এ পার ও পার করতাম। সে সব দিন কোথায় হারিয়ে গেল?

Advertisement

উন্নয়নের জোয়ারে পাড়াটা আজ ঝাঁ-চকচকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জোরালো আলোয় রাতেও পাড়াটা উজ্জ্বল। কাউন্সিলর সুস্মিতা দাম ভালই কাজ করছেন। এলাকার এমএলএ অরূপ বিশ্বাসও উন্নয়নে আন্তরিক ভাবে সহায়তা করেছেন। উন্নত হয়েছে নাগরিক পরিষেবা। দু’দিন অন্তর মশার তেল, ব্লিচিং ছড়ানো হয়। কাছেই রয়েছে সুসজ্জিত উদ্যান। প্রবীণরা ও মহিলারা সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটতে যান। তবে পাড়ায় কোনও ফুটপাথ নেই। তাই বেশির ভাগ বাড়িগুলি রাস্তার গা ঘেঁষা।

এ পাড়ায় এখন বহুতলের সংখ্যাই বেশি। এক একটা বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। পাড়ায় পুরনো বাড়ি বলতে হাতে গোনা কয়েকটা। আগের তুলনায় মানুষে মানুষে যোগাযোগ, দেখা সাক্ষাতের সময় কমেছে। এখন সকলেই যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নিজের জগতে ভাসমান। পাড়ার পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল সেই আশির দশক থেকে। ক্রমেই বাড়তে থাকা লোকসংখ্যা, কমতে থাকা পুরনো বাড়ির সংখ্যা আর মূল্যবোধের পরিবর্তন পাড়াটাকে একটু একটু করে বদলে দিল।

তবে এখনও পাড়ায় কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বিপদে আপদে, যে কোনও সমস্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। এক বার পাড়ার এক জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং সেই সময় অ্যাম্বুল্যান্সের চালক না থাকায় এক পড়শিই অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।

আমাদের পাড়ার ক্লাব উদয় সঙ্ঘ। তার গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে কত গল্প। আজ বলতে বাধা নেই, এক সময় আমরা চুরি করে ক্লাবটা তৈরি করেছিলাম। তখন আমাদের কারও আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। মনে পড়ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে মাথায় করে ইট, বালি, চুন, সুরকি, সিমেন্ট লোহা রড চুরি করে এনে ক্লাবটা তৈরি হয়েছিল। পাড়ার বড়রা ব্যাপারটা জানলেও চোখ ঘুরিয়ে রাখতেন। কারণ তাঁরাও জানতেন ছেলেরা কিছু একটা ভাল কাজ করতে চাইছে। সেই ক্লাবটায় আজ একটি বড় পাঠাগার আছে। নিয়মিত স্বাস্থ্যশিবির হয়। তাতে যোগ দেন বিশিষ্ট চিকিৎসকরা। ভাবতে ভাল লাগে এখনও কোনও রাজনৈতিক দল ক্লাবটাতে থাবা বসায়নি।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

এক কথায় আমাদের পাড়াটা শান্তিপূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট। কোনও রাজনৈতিক অশান্তি নেই। পাড়ায় দুর্গাপুজোর পাশাপাশি আজও হয় পঞ্চকালী পুজো। হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাড়ার ছোটরা নাটকে অংশগ্রহণ করে। আসেন খ্যাতনামা শিল্পীরাও। বৈষ্ণবঘাটার রথতলা মানেই বহু পুরনো সেই রথের মেলা। তবে মেলার পুরনো চরিত্রটা বদলেছে। কমেছে মাটির পুতুল, নাগরদোলা, আর ছেলেবেলার আকর্ষণীয় সব খেলনা। পরিবর্তে এসেছে প্লাস্টিকের জিনিস আর স্টোন ডাস্টের পুতুল।

কালের প্রভাবেই হোক বা সময়ের অভাবে, কমেছে পাড়ার আড্ডার পরিবেশ। রকগুলি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে স্মৃতির খাতায় নাম লিখিয়েছে পাড়ার রকের আড্ডাটাও। পাড়ার প্রবীণরা এখনও আড্ডা দেন রাজা এস সি মল্লিক রোডের মুখে একটি চায়ের দোকানে। রবিবার লোকজন বেশি আসায় আড্ডার আমেজটা যেন পূর্ণতা পায়। এই আড্ডার প্রসঙ্গে মনে পড়ছে পাড়ার বনুর কথা। সে ছিল জন্মান্ধ, তবু স্পর্শ করেই বলে দিতে পারত কোনটা কে। সে ছিল কট্টর মোহনবাগানের সমর্থক। এক দিন সুব্রত ভট্টাচার্যকে (বাবলুদা) অনুরোধে করায় তিনি আমাদের পাড়ার সেই রকে এসেছিলেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বনু তাঁকে ছুঁয়ে হঠাৎ জি়জ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুমি কি বাবলুদা?’’ আজ সেই রকটাও নেই, বনুও নেই, আর নেই সেই অন্তরের অনুভূতিটাও।

একটা জিনিস মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে। পড়াশোনার পাঠ শেষ হতে না হতেই পাড়ার বেশির ভাগ ছেলেরা হয় শহরের বাইরে, না হয় দেশের বাইরে কর্মরত। তাই কিছুটা হলেও কমেছে পাড়ার যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যাটা। এক সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় মনের সুখে চাকা চালিয়েছি। গুলি, ডাংগুলি কত কী খেলেছি। সেখানেই এখন এত গাড়ির চলাচল যে একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সময়ের সঙ্গে কমেছে ছোটদের খেলাধুলার সময়।

এ পাড়ায় থাকতেন কিছু বিখ্যাত মানুষ। যেমন পরিতোষ চক্রবর্তী, অংশুমান রায়। এখন থাকেন সুকুমার সমাজপতি, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর বৈষ্ণবঘাটা বাই লেনে কবীর সুমন।

এখনও গভীর রাতে যখন পাড়ায় ফিরি অদ্ভুত একটা শান্তি, স্বস্তি অনুভব করি। ওই যে বলে শিকড়ের টান, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement